ইউরোপীয় শিক্ষাপদ্ধতি by জাবির আল ফাতাহ

স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ
বিদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রতিনিয়ত অনেক প্রশ্নই আমাদের মনে জাগে। আমার দেশীয় বন্ধুরা এখানকার পড়াশোনার ধরন ও পাঠ্যক্রম বিষয়ে জানতে অনেক আগ্রহী। তাই এবার আমি বিশেষ করে সুইডেনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার ধরন নিয়ে আলোচনা করব।
অনেকে ভাবতে পারেন বিদেশ মানেই মেধা গড়ার কারখানা ও উন্নত দেশের স্কুল-কলেজে যারা অধ্যয়ন করে সবাই মেধাবী। এমন ধারণা করে থাকলে সেটা পুরোপুরি ভুল। সত্যটি হলো একটি উন্নত দেশের বেশির ভাগ মানুষই পরিশ্রমী ও স্বনির্ভর। কথায় আছে যে জাতি যত পরিশ্রমী সে জাতি তত উন্নত | সুইডেনে একটি বিদ্যালয় অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীরা সমান সুবিধা ভোগ করে ও মেধা বিকাশের সমান সুযোগ পায়। বাংলাদেশের মতো এখান ব্যাকবেঞ্চার স্টুডেন্ট বলতে কিছু নেই।
আমাদের দেশে কতিপয় শিক্ষার্থী খুব গুরুত্ব সহকারে প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষায় একটি ভালো ফলাফল করার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে ওঠে। অন্যদিকে কেউ কেউ আর্থিক দুরবস্থার নানা কারণে কোচিংয়ে যেতে পারে না বলে মানসিক হীনমন্যতা তাদের দুর্বল করে রাখে। পরিণামে আত্মবিশ্বাস হারায়। আর এখানে ঠিক তার উল্টো | কোচিং বলতে কিছু আছে সেটা অনেকে জানেও না। সকল শিক্ষার্থী সমান উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সামনে এগোয়। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সময় ও মেধা উৎসর্গ করেন | যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুল চলবে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান।
পরীক্ষায় খারাপ, গণিতে কম নম্বর পাওয়া ও পড়াশোনায় মনোযোগ কম—এ ধরনের শিক্ষার্থী এখানেও অনেক আছে। স্কুল পর্যায়ে এ ধরনের ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ দেখভাল করার ব্যবস্থা আছে। তাদের কখনোই নিরুৎসাহিত করা হয় না। দুর্বল শিক্ষার্থী বলে শ্রেণিকক্ষে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় না। আমাদের দেশে কেউ পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে ভাবি ছেলে অথবা মেয়েটির মাথায় তো কিছু নেই! ভাবখানা এমন যে আমরা কেউ তার মাথার মধ্যে ঢুকে মেধা মাপক যন্ত্র সেট করে রেখেছি এবং সব সময় সেখান থেকে আপডেট পাচ্ছি। আসলে শুধুমাত্র কাগজে কলমে ও হাতে গোনা কয়েকটি পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে কারও বুদ্ধি যাচাই সম্ভব নয়। আর কারও মাথায় ঢুকে ব্রেন যাচাই করাও সম্ভব না।
উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডিং রুম
এতক্ষণ বললাম পড়ালেখার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। এবার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ও সেগুলোতে উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি নিয়ে কিছু বলতে চাই।
সুইডেনে বর্তমানে ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সবগুলোই সরকারি অনুদানে পরিচালিত। এআরডব্লিউইউ-র (ARWU—Academic Ranking of World Universities) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুইডেনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় আছে। এর মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (স্টকহোম ইউনিভার্সিটি, উপসালা ইউনিভার্সিটি ও লুন্ড ইউনিভার্সিটি) অবস্থান বরাবরই বিশ্বের সেরা এক শর মধ্যে আছে। সব প্রতিষ্ঠান মোটামুটি একই কারিকুলাম অনুসরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাচেলর লেভেল তিন বছর ও মাস্টার্সের জন্য এক অথবা দুই বছর নির্ধারিত থাকে। এক শিক্ষাবর্ষে দুই সেমিস্টার সম্পন্ন করানো হয়।
প্রতি সেমিস্টারকে ৩০ ক্রেডিট সমমান ধরা হয়। শিক্ষা পদ্ধতি পরিচালনার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বহুল ব্যবহৃত একটি হলো ইটসলার্নিং (ওয়েবসাইট: itslearning. eu/)। ক্লাস ও কোর্স সম্পর্কিত যেকোনো আপডেট ইটসলার্নিং-এ পাওয়া যায়। যেকোনো অ্যাসাইনমেন্ট অথবা পেপার জমা দেওয়া ও শিক্ষক-সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগসহ যাবতীয় কাজ ইটসলার্নিংয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। কোনো পেপার হাতে লিখে জমা দেওয়া অথবা গ্রহণ করার প্রচলন নেই।
যেহেতু কোচিংয়ের কোনো রীতি নেই তাই ক্লাসে উপস্থিত থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাস চলাকালে কোনো শিক্ষকই হুটহাট করে নির্দিষ্ট করে একজন শিক্ষার্থীকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বিপাকে ফেলতে চান না। ক্লাস শেষেও যে কেউ ইচ্ছা করলে শিক্ষকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো বিষয় বুঝে নিতে পারে। মোটামুটি সব শিক্ষকরাই বন্ধুসুলভ ও অত্যন্ত আন্তরিক। যদিও আন্তরিকতার মাত্রাটি শিক্ষকভেদে তারতম্য হতে পারে।
লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস
পরীক্ষার পদ্ধতি একটু অন্যরকম। বেশির ভাগ লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নই সৃজনশীল পদ্ধতিতে করা হয়। কিছু বিষয়ের পরীক্ষার সময় বই সঙ্গে রাখার অনুমতি থাকে। অনেকে ভাবতে পারেন বই দেখে পরীক্ষা দেওয়ার মানে কি? কিন্তু আসলে প্রশ্নপত্র এমনভাবে করা হয় যে, বই থেকে কোনো কিছু হুবহু খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করতে পারে। যেমন গণিত পরীক্ষায় যে সূত্রগুলো সহজে মনে আসে না সেগুলো বই থেকে দেখে নেওয়া যায়। আবার বই থেকে কিছু তথ্য ও উপাত্তের প্রয়োজন হতে পারে যেগুলো মনে রাখা প্রায় অসম্ভব। পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময়কাল বেশ দীর্ঘই থাকে বলতে গেলে। সাধারণত একটি কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা চার অথবা পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী হয়। একজন নিয়মিত ছাত্রের জন্য এই সময় যথেষ্ট। যেকোনো পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৫০% নম্বর পাওয়া আবশ্যক।
সবশেষে আমি বলব এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধুমাত্র একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরং পৃথিবীর বহু দেশ থেকে আগত নানা সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার মিলনমেলা। বিভিন্ন দেশের বহু ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক সাথে অধ্যয়নের মাধ্যমে পরস্পরকে জানা যায়। আরও জানা যায় বহির্বিশ্বের নানা অজানা তথ্য। এভাবে বহুজাতিক মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে উঠে এক চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক বন্ধন। যেটার মাধ্যমে জ্ঞান ও জানার পরিধিকে বহু গুনে বিকশিত করার এক দারুণ সুযোগ মেলে।
(লেখক শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং)

No comments

Powered by Blogger.