যে দেশে প্রতি ঘণ্টায় খুন

মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে ছোট দেশ এল সালভাদরের রাজধানী সান সালভাদরের শহরতলি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি শহরের মতোই। ট্রাফিক, বিপণিবিতান এবং আমেরিকান ফাস্টফুডের চেইনও চোখে পড়ে। গাছগাছালিভরা শহরকে মনে হয় শান্ত কোনো এলাকা। কিন্তু আসলে হয়তো জনপদটি সে রকম নয়। ভালোমতো খেয়াল করলে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঢাকা, নিরাপত্তারক্ষীদের অবিরত টহল। প্রধান প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রের প্রবেশমুখে চোখে পড়ে শটগানসহ ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী। মহাসড়কগুলোতেও যখন-তখন গাড়ি তল্লাশি করছে পুলিশ। এত নিরাপত্তাব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগায় মনে। ঘনবসতিপূর্ণ ছোট এই দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া যেকোনো স্থানের চেয়ে অনেক বেশি খুনের ঘটনা ঘটে এখানে। এল সালভাদরে সরকার ও অপরাধীদের মধ্যে সংঘটিত ২০১২ সালের অস্ত্রবিরতি চুক্তি ভেঙে গেছে। এ বছর সেখানে ৩ হাজার ৮৩০টির বেশি খুন হয়েছে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে তিন শর বেশি সন্ত্রাসী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও মারা গেছেন অর্ধশতাধিক। চলতি আগস্ট মাসে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় হয়েছে একটি খুন। দেশটির সরকারের সঙ্গে অপরাধীদের ১৯৯২ সালের চুক্তির পর এখনই সবচেয়ে প্রাণঘাতী অবস্থা বিরাজ করছে। বর্তমান অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে, তবে এ বছর প্রতি এক লাখে ৯০ জন হত্যার শিকার হবে। আর তা হলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী দেশ হন্ডুরাসকেও ছাড়িয়ে যাবে দেশটি। ধারণা করা হয়, দেশটিতে সন্ত্রাসীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এদের মধ্যে ১০ হাজারের বেশিই কারাগারে।
দেশটির জনসংখ্যার প্রতি ১০ জনে একজন সন্ত্রাসী দলের ওপর নির্ভরশীল। আর বিচার হয় না ৯৫ শতাংশ অপরাধেরই। সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, সন্ত্রাসীরা প্রধানত দুটি দলে বিভক্ত। একটির নাম মারা সালভাচুরা (এম এস-১৩ নামে পরিচিত)। আরেকটি বারিও-১৮। প্রায়ই দুটি দলের মধ্যে সংঘর্ষ ও প্রতিশোধমূলক হত্যার ঘটনা ঘটে। এই ‘মারা সালভাচুরা’ হলো লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক একটি সন্ত্রাসী দল। ১৯৯২ সালে এল সালভাদরের গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত দেশটির অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করা হয়। এই নির্বাসিতরাই গত দুই দশকে দেশটির দুর্বল সরকার কাঠামোতে সন্ত্রাসবাদের আমদানি করে। তবে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোর মাফিয়া চক্রের মতো সংগঠিত নয় এল সালভাদরের সন্ত্রাসী দলগুলো। এমনকি এই দেশটি দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কোকেন পাচার হলেও তাতেও জড়িত নয় এখানকার সন্ত্রাসীরা। তাদের আয়ের মাধ্যম হলো ডাকাতি ও ছিনতাই। আর তাদের সন্ত্রাসের আশঙ্কা থেকে বাদ নেই একজন নাগরিকও। সবচেয়ে হুমকির মুখে দরিদ্র পরিবারগুলো। এই অবস্থা থেকে রাষ্ট্রটিকে একটি স্বাভাবিক জায়গায় আনার জোর চেষ্টা করছে প্রেসিডেন্ট সালভাদর সানচেহ সেরেনের নেতৃত্বাধীন এফএমএলএন সরকার। এর আওতায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী দিয়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় অভিযান চালানো হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও পুলিশকে দেওয়া হচ্ছে দায়মুক্তি। আর নতুন সমস্যা শুরু হয়েছে সেখান থেকেই। কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো। দেশটির সেন্ট্রো-আমেরিকানো ইউনিভার্সিটির জনমতবিষয়ক সংস্থার পরিচালক জেনিথ আগিলা বললেন, পুলিশই এখন বড় সন্ত্রাসী। অবস্থা থেকে পরিত্রাণে দেশে অস্ত্রবিরতি পুনর্বহালের জন্য কারাগারে বন্দী সন্ত্রাসী নেতারা গত জুন মাসে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিল। যদিও তরুণ অপরাধীরা এর ঘোর বিরোধী। এমনকি উপ-পুলিশপ্রধান হাওয়ার্ড কট্রোর মতে, অস্ত্রবিরতির নামে নিজেদের সংগঠিত করবে সন্ত্রাসীরা। তবে সংকট উত্তরণে আলোচনাই যে একমাত্র পথ এমন ধারণাও অনেকের। সূত্র: গার্ডিয়ান।

No comments

Powered by Blogger.