শিশু রাজন হত্যাকাণ্ডঃ একে একে ধরা পড়েছে সব আসামি

সিলেটের শিশু শেখ মো. সামিউল আলম রাজনকে (১৪) নির্যাতন করে হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত সব আসামিই একে একে ধরা পড়েছে। মামলার এজাহারে নাম ছিল যে চারজনের, এ চারজনকেই জনতা ধরে পুলিশে দিয়েছে। চার আসামিকে পালাতে সহায়তাকারী, ঘটনা প্রত্যক্ষ করা ও নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণকারীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও ছয়জনকে। গতকাল সোমবার রিমান্ড শেষে অন্যতম আসামি ময়না মিয়া আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সর্বশেষ পর্যায়ে ঘটনার পর থেকে পলাতক থাকা আলী হায়দার ওরফে আলীকে (৩৪) গত শুক্রবার দুপুরে জনতা ধরে পুলিশে দিয়েছে। আলী এর আগে একইভাবে গ্রেপ্তার হওয়া ঘটনার মূল হোতা কামরুল-মুহিতের ভাই। এর পরদিন শনিবার দুপুরে পুলিশ সিলেটের টুকেরবাজার থেকে আলীর শ্যালক রুহুল আমিনকে (২৯) গ্রেপ্তার করে। এ দুজনকে পৃথকভাবে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে গত রোববার থেকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ঘটনার মূল হোতাসহ জড়িত একে একে সব আসামি ধরা পড়ায় এবার হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের দাবি উঠেছে। ঈদের আগের দিন গত শুক্রবার দুপুরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সামিউলের বাড়িতে গেলে সামিউলের মা ও বাবা জানান, বিচার না পেলে তাঁরা ঈদ করবেন না। এলাকাবাসীও অর্থমন্ত্রীর কাছে এ দাবি জানান। অর্থমন্ত্রীও দ্রুত বিচার বিষয়ে শুক্রবার বিকেলে সিলেটের পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। গতকাল সোমবার সিলেট নগরের বৃহত্তর বাগবাড়ী এলাকাবাসীর উদ্যোগে হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে।
মামলার তদন্ত সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. রহমত উল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে জানান, ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সব আসামিই গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে আর কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে পুলিশ আটক করে তদন্ত করবে। বিচার দ্রুত করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা আমরাও চাই। ধরা পড়া সব আসামিই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করায় পুলিশ দ্রুতই তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
৮ জুলাই ভোরে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কুমারগাঁও বাসস্টেশনে সামিউল আলম রাজনকে বেঁধে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ওই দিন দুপুরে লাশ গুম করার চেষ্টার সময় কুমারগাঁও থেকে জনতা মুহিত আলম (৩৫) নামের একজনকে ধরে পুলিশে দেয়। মুহিতের বাড়ি শেখপাড়ায়। শিশু সামিউলের বাড়ি সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার বাদেয়ালি গ্রামে। তার বাবা মাইক্রোবাসের চালক। সামিউল সবজিবিক্রেতা ছিল। কুমারগাঁও বাসস্টেশনে সবজি বিক্রি করতে গিয়েছিল।
অভিযোগ ওঠে, এ ঘটনায় তাঁর আরও তিন ভাই জড়িত। প্রথমে সামিউলের মরদেহ অজ্ঞাত বলে মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় মামলা হয়। ওই দিন রাতে লাশের পরিচয় উদ্ঘাটন হলে বাবা শেখ মো. আজিজুর রহমান একটি এজাহার দাখিল করলে সেটি মামলা হিসেবে না নিয়ে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। সামিউলকে নির্যাতন করার সময় নির্যাতনকারীরা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে দিতে ভিডিওচিত্র ধারণ করে রেখেছিলেন। ২৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্র দেখে ঘটনার তিন দিন পর ১২ জুলাই প্রথম আলোয় ‘নির্মম, পৈশাচিক!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সর্বত্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
পরে জালালাবাদ থানা-পুলিশও সামিউলের বাবার দাখিল করা এজাহার মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। পুলিশের বিরুদ্ধে আসামিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগ ওঠায় মামলার বাদী জালালাবাদ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরপর মামলাও পুলিশ থেকে গোয়েন্দা পুলিশে স্থানান্তর হয়।
এদিকে শিশু সামিউলকে নির্যাতন করার ভিডিওচিত্র প্রকাশ পাওয়ায় দেশে-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার পরপরই পালিয়ে যাওয়া মূল হোতা কামরুল ইসলামকে (২৮) সৌদি আরবের জেদ্দায় জনতা ধরে সৌদি পুলিশ হেফাজতে দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে এলাকাবাসী ধরে পুলিশে দেয় চৌকিদার ময়না মিয়া, কামরুলের আরেক ভাই হায়দার আলী ওরফে আলী, ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর আহমদ, ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা শেখপাড়ার দুলাল আহমদকে।
জালালাবাদ থানার পুলিশ মুহিতের স্ত্রী, শ্যালক ইসমাইল হোসেন ওরফে আবলুচ, নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা ফিরোজ মিয়া ও আজমত উল্লাহ এবং সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া আলীকে পালাতে সহায়তাকারী তাঁর শ্যালক রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করে।
বাড়িতে অর্থমন্ত্রী, অনুদান: গত শুক্রবার বেলা দুইটায় সামিউল আলম রাজনের বাড়িতে যান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সামিউলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও তার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে অর্থমন্ত্রী পাঁচ লাখ টাকার সরকারি অনুদান দেন। এর মধ্যে নগদ ৫০ হাজার টাকা সামিউলের বাবার হাতে তুলে দেন। সামিউলের বাড়িতে অবস্থানকালে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ঘটনায় খুনিদের কোনো ছাড় নেই। একে একে ধরা পড়ছে, দ্রুত বিচারও হবে।’
আদালতে ময়নার জবানবন্দি: জনতার হাতে ধরা পড়ে গ্রেপ্তার হওয়া চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল বিকেলে ময়নার রিমান্ড শেষে মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হলে বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত পৌনে আটটা পর্যন্ত তাঁর জবানবন্দি নেওয়া হয়। আদালতের বিচারক মো. আনোয়ারুল হক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (আদালত) আবদুল আহাদ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
১৪ জুলাই রাতে ময়নাকে তাঁর মা ছমিরুন নেছা বাড়িতে খবর দিয়ে এনে এলাকাবাসীর হাতে তুলে দেন। ওই রাত সাড়ে ১০টার দিকে এলাকাবাসী ময়নাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করলে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। শিশু সামিউল আলম রাজনকে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ধরা পড়া ১০ আসামির মধ্যে ময়না মিয়াই সবার আগে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন।

No comments

Powered by Blogger.