‘ভারতকেই হিস্যা বুঝিয়ে দিতে হবে’ by মিজানুর রহমান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর তার সফরের অর্জনের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। দুই  ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খাতা মিলাচ্ছেন দেশীয় সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক  বিশ্লেষকরা। সফরের ‘ফল’ বিশ্লেষণে ভিন্নমত থাকলেও ৩৬ ঘণ্টার ওই সফরে যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে সে বিষয়ে মোটামুটি অভিন্ন মত বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, মোদির সফরে ঢাকা-দিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কের আগামী দিনের পথ চলায় যেসব বিষয়ে যে ঐকমত্য ঘোষণা, দলিল, চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক হয়েছে তাতে নেতিবাচক কিছু নেই। উদ্যোগগুলোকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখছেন ঢাকার কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা। এখন তারা জোর দিচ্ছেন দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ওই অঙ্গীকার, সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায়। সেখানে আরও তীক্ষ্ন আলোচনা এবং দরকষাকষির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কিভাবে তার স্বার্থ সুরক্ষা করতে পারে এবং সেখানে আঞ্চলিক যোগাযোগ, ট্রানজিট-কানেটিভিটিসহ যেসব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হতে পারে সেটি নিশ্চিত করার ওপর। কেউ কেউ বলছেন, ভারত বড় দেশ হিসাবে সেখানে বেশি  লাভবান হবে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ যেন তার ন্যায্য হিস্যা পায় সেটি ভারতকেই নিশ্চিত করতে হবে।
ওয়াশিংটন ও কলকাতায় বাংলাদেশের দূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এম. হুমায়ুন কবির বলেন, মোদির সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বড় কিছু অর্জন হয়েছে, তেমনটি মনে হয় না। চার বছর আগে ইউপিএ সরকারপ্রধান মনমোহন সিং যে প্রক্রিয়া শুরু করে গিয়েছিলেন, কোন ক্ষেত্রে মোদি সেটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারেননি। ট্রানজিট-কানেক্টিভিটিসহ ঢাকা-দিল্লি বিভিন্ন উদ্যোগে বাংলাদেশ কিভাবে ‘সমভাবে’ লাভবান হতে পারে সেই প্রচেষ্টা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। তার মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল- কানেক্টিভিটি বা সংযোগ। এই সংযোগে দুই দেশই সমভাবে লাভবান হতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনার দাবি রাখে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ট্রানজিট চুক্তি তিন বছর পর পর নবায়ন হতো। এখন থেকে চুক্তিটি পাঁচবছর পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে চুক্তি পর্যালোচনার ও মূল্যায়নের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এ সফরে দুটি সড়কে বাস সার্ভিস চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দুই  দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়লেও অধিক সুবিধা পাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এতদিন তাদের দীর্ঘ পথ ঘুরে আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে হতো। এখন তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে। ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে বেড়াতে আসবে। এতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প লাভবান হবে। তবে এই পরিবহন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ভাড়া ও মাশুল হিসেবে কী সুবিধা পাবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। উপকূলীয় পরিবহন দুইদেশের জন্যই লাভজনক হবে এমন ধারণা দিয়ে তিনি বলেন, এতে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় কমবে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের যে সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পরিমাণ মাশুল পাবে, সেটিও স্পষ্ট নয়। ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নৌ ও সড়ক দুটি পরিবহনই ব্যবহার করতে চাইবে। ইতিমধ্যে সাবরুমে সেতু বানানো হচ্ছে। আমাদেরও দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর জন্য উপযুক্ত মাশুল দিতে হবে। উত্তর-পূর্ব ভারতে আগে ঘুরাপথে পণ্য পরিবহনে যে বাড়তি খরচ হতো, তার একটা অংশ বাংলাদেশ পেতে পারে। একইভাবে নেপাল ও ভুটান যাতে নেপাল বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা ভারতকে দিতে হবে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে তিনি বলেন, মোদির বিবৃতিতে তিনি তিস্তার বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের মোটেই আশান্বিত করে না। তিনি বলেছেন, ‘আমি আস্থাশীল যে, রাজ্য সরকারগুলোর সমর্থনে ফেনী ও তিস্তা সমস্যার ন্যায্য সমাধানে পৌঁছাতে পারবো।’ কবে সমাধান হবে তা তিনি বলেননি। দ্বিতীয়ত, তিস্তা ও ফেনীর পানি বণ্টনের বিষয়টি আলাদা হলেও তিনি একসঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এতে কিছুটা হলেও সংবেদনশীলতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি বরাবরই ভারত গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। আমরাও মনে করি, এ ব্যাপারে আমাদেরও মনোযোগ বাড়াতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর আমেনা মহসিনের মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট টাইমফ্রেমের ঘোষণা আশা করেছিল ঢাকা। যদিও ওই সফরে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হবে না মর্মে আগেই দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জানিয়ে দিয়েছিলেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে মোদির স্পষ্ট বক্তব্য এবং অঙ্গীকারের বিষয়টি স্মরণ করে ওই  বিশ্লেষক বলেন, তিস্তার পানির বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকার প্রধানের সফরে মানুষের প্রত্যাশা একটি বেশি ছিল। এ নিয়ে ‘সুনির্দিষ্ট’ বক্তব্য না আসার বিষয়টি হতাশাজনক। বিষয়টি অনির্দিষ্টকাল ঝুলিয়ে রাখলে ‘আস্থা’ এবং ‘গুড উইল’ দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রফেসর আমেনা মহসিন মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, যেখানে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেখা হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে মনে করেন না তিনি। সেখানে মোদি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রায় ১৫ মিনিট তাদের মধ্যে একান্ত বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠক করার মধ্য দিয়ে মোদি একটি রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন বলে মনে করেন ওই বিশ্লেষক। বাংলাদেশকে নিয়ে চলতে চাওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সব অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন বলে মনে করেন তিনি। ট্রানজিট-কানেকটিভিটির যেসব চুক্তি এবং সমঝোতা হয়েছে বিশেষ করে বাণিজ্য চুক্তি ৫ বছর অন্তত অটো নবায়নের বিষয়ে যে ঘোষণা এসেছে সেখানে বাংলাদেশের দিক থেকে একটি ক্লোজ থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। আঞ্চলিক যোগাযোগের ওই উদ্যোগে কেবল বাংলাদেশ-ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানকে যুক্ত করার যে ঘোষণা এসেছে তার প্রশংসা করেন তিনি। খাতওয়ারি বিশ্লেষণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ভারতের সরকার প্রধানের ওই সফরে আঞ্চলিক যোগাযোগসহ উন্নয়নের যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে আমি নেতিবাচক কিছু দেখি না। এগুলোর বাস্তবায়নের মডালিটিজ নির্ধারণে আমরা কিভাবে আমাদের স্বার্থ সুরক্ষা করতে পারি তা নিয়ে চলমান আলোচনা আরও জোরদার হওয়া উচিত।
ভারতের যে কোন প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের চেয়ে নরেন্দ্র মোদির  এবারের সফর ‘ব্যতিক্রম’ ছিল বলে মনে করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। সদ্য সমাপ্ত ওই সফরটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে ওই বিশ্লেষক বলেন, এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অঙ্গীকার করে গেছেন ভারতের সরকার প্রধান। আমি মনে করি এখন বড় বিষয় হচ্ছে সেসবের পূর্ণ বাস্তবায়ন। ভারত তার অঙ্গীকার রক্ষা করবে এবং বাংলাদেশকে সম-মর্যাদা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তারেক শামসুর রেহমান মনে করেন বাংলাদেশের প্রত্যাশাগুলো যৌক্তিক ছিল। সেখানে ছিল তিস্তার পানি বণ্টন, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, আঞ্চলিক কানেকটিভিটির সঙ্গে চীনকে যুক্ত করা। ভারতের ৭টি রাজ্যে পণ্য পরিবহনে ওয়্যার হাউজ স্থাপন, এলসি ওপেন করার ক্ষেত্রে বাজার নিরসন, ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনি বাধা নিরসন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, ভিসা সহজীকরণ ইত্যাদি। মোদি-হাসিনা ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে এমন অনেক বিষয় রয়েছে। ২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, একতরফাভাবে ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প এগিয়ে নেবে না। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এতদিন সেখানে ভারত যে বিনিয়োগ করেছে তার কি হবে? দ্বিতীয় যে বিষয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারত একতরফাভাবে এগিয়ে না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে এটি ভাল সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। ওই বিশ্লেষক বলেন, ব্লু ইকোনোমি ও উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজ চলাচল, মংলায় ভারতের জন্য স্পেপাল ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠাসহ বিদ্যুৎ ও পরিবেশ উন্নয়নে অনেক ভাল উদ্যোগ রয়েছে। এখানে ট্রানজিট কানেকটিভিটিতে ভুটান ও নেপালকে যুক্ত করে চতুর্দেশীয় যান চলাচলের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটি মূলত ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালের উদ্যোগ। এটি দীর্ঘদিন চাপা পড়েছিল এখন আবার চাঙ্গা হলো। আমি মনে করি, আঞ্চলিক ওই সংযোগ ও সহযোগিতায় ভারত বড় রাষ্ট্র হিসেবে তাদের বেশি সুবিধা হবে। কিন্তু বাংলাদেশকেও তার স্বার্থ আদায় করে নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.