বার কাউন্সিলের সংস্কার দরকার by মিজানুর রহমান খান

বার ও বেঞ্চকে তুলনা করা হয় রথের সঙ্গে। রথ চলে দুই চাকায় ভর করে। যেকোনো একটি চাকা না চললে রথ চলতে পারে না। একে এক নদীর দুই তীরের সঙ্গেও তুলনা করা হয়, এক তীর না থাকলে ‘বিচারের স্রোত’ বইতে পারে না। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আইনজীবীদের অদক্ষতার কারণে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মামলায় বিচারপ্রার্থীদের হার ঘটে বলে মন্তব্য করেছেন। প্রায় একই সময়ে আমাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বার কাউন্সিলের ৪৮ হাজার ৪৬৫ জনের ভোটার তালিকায় গুরুতর অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি তুলেছে। শাহদীন মালিক প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে সমর্থন করে প্রথম আলোয় একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যেখানে তিনি আইন শিক্ষার উন্নতি ও বার কাউন্সিলে বর্তমান ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দশ গুণ বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। সামগ্রিক বিচারে বিচার বিভাগে যে বড় ধরনের সংস্কার দরকার, সে বিষয়ে আর সংশয় থাকে না।
আজ যিনি আইনজীবী, কাল তিনিই বিচারপতি। হাইকোর্টের বিচারক হতে সংবিধানে বলা আছে ‘অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট’ বা একই সময় কোনো ‘বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান’ থাকলেই চলবে। যেহেতু ৯০ শতাংশের বেশি হাইকোর্টের বিচারক আইনজীবী কোটা থেকে আসেন, তাই বার কাউন্সিলের কার্যক্রমে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত থাকা দরকার। বার কাউন্সিলের আচরণবিধি বলছে, আইনজীবী পেশা ‘মানি মেকিং ট্রেড’ নয়। দক্ষতার ভিত্তিতে উপযুক্ত ফি নিতে হবে। মক্কেল ধনী হলেও বেশি টাকা নেওয়া বারণ। আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা চলে বার কাউন্সিলের সদস্য চালিত ট্রাইব্যুনালে। অধিকাংশ মামলাই এখানে খারিজ হয়, ভুক্তভোগীরা বিচার পান না।
গত ৯ এপ্রিল প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকার ভিত্তিতে বৈধ প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর সর্বসম্মতভাবে ভোটার তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অথচ সরল প্রশ্ন, ভোটার তালিকা অবৈধ হলে প্রার্থীর তালিকা কী করে বৈধ হয়? এক আইনজীবী দেশের যেকোনো জেলায় ওকালতি করতে পারেন। সে জন্য কেউ চাইলে ৮১টি বারের সবটিরই সদস্য হতে পারেন। কিন্তু যখন কেন্দ্রীয় বার কাউন্সিল নির্বাচন হবে, তখন এক বার-এক ভোট হবে। কিন্তু তা হয়নি। এক ব্যক্তির নাম অন্তত দুটি বা তিনটি বার থেকে ছাপা হয়েছে। তাই বর্তমান নির্বাহী কমিটির আওয়ামী লীগ–সমর্থিত পাঁচ সদস্য যথার্থই ভোটার তালিকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । কিন্তু এই ত্রুটির প্রকৃতি টেকনিক্যাল। এর বাইরে এনরোলড আইনজীবীদের মূল তালিকার শুদ্ধতা ও বৈধতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলতে চাই। কারণ, সাড়ে ৪৮ হাজার ভোটারের মধ্যে কেবল দ্বৈত ভোটারের মামুলি সমস্যার চেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানে বিপুলসংখ্যক ‘নন–প্র্যাকটিসিং’ সদস্য রয়েছেন। গত চার দশকে কখনো এ প্রশ্ন তোলা হয়নি। এ প্রশ্নের সুরাহা ছাড়া গঠিত কোনো বার কাউন্সিল সংবিধানসম্মত বলে দাবি করতে পারে না। এনরোলমেন্ট বা সদস্যভুক্তির সময় একজন আইনজীবী হলফ করে বলেন, আমি অন্য কোনো পেশায় নেই। কিন্তু পরে অনেকেই পেশা বদলান, অনেকেই নিয়মিত প্র্যাকটিসে থাকেন না।
বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে কয়েক বছর সক্রিয় থাকা এক আইনজীবীর কাছে জানতে চাইলাম, ‘নন–প্র্যাকটিসিং লইয়ার্স লিস্ট’ তৈরি হয় কি? তিনি বললেন, না। তাদের সংখ্যা কত হতে পারে? তিনি একবাক্যে বললেন, কমপক্ষে ১০ হাজার। বিএনপি আমলের এক সাবেক মন্ত্রী বলেন, এটা ১৮ হাজারের কম নয়। এখন ভোটার তালিকার ত্রুটিজনিত যে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে হয়তো বেশি হলে তিন হাজার নাম একাধিকবার ছাপা হওয়ার প্রশ্ন জড়িত। ২৪ মে আপিল বিভাগের শুনানিকালে প্রায় ১ হাজার ৬০০ নাম বাদ পড়া নতুন মুদ্রিত ভোটার তালিকা বার কাউন্সিল জমা দিয়েছে।
আমরা মনে রাখব, নন–প্র্যাকটিসিং আইনজীবী, যাঁদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি বলেই অনুমেয়, তদন্ত করে তাঁদের নাম বার কাউন্সিলের খাতা থেকেই খারিজ করা দরকার, সে বিষয়ে কোনো দাবি তোলা হয়নি। বিএনপি নীরব। আওয়ামী লীগ নীরব। উভয়কে এই নীরবতা ভাঙতে আবেদন জানাই। নীরবতা ভেঙে তাদের করণীয় কী, সে জন্য তাদের চিন্তার খোরাক দিচ্ছি।
২০০৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বার ‘এক বার-এক ভোট’ বিধান চালু করে। ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এলাহাবাদ হাইকোর্টের একটি রায়ে লেখা দেখি: ২০০৩ সালের ১০ নভেম্বর হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে: এটা একটা প্রহসন। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নামে একটি প্যারোডি ঘটছে, যেখানে বাইরে থেকে আইনজীবী নামধারীদের পাচার করে আনা হয়, মন্তব্য করেছেন একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, যিনি হাইকোর্ট বার সমিতির নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হতে রাজি হননি। বার সমিতির নির্বাচন টাকা বানানোর (এতে ১ কোটি রুপি খরচ হয়) খেলায় পরিণত হয়েছে। তারা তাই যত খুশি তত সংখ্যায় বারের সদস্য বানায়। এক দিনের জন্য এরা ভোট দিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। বার সমিতি ‘মানিব্যাগ দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার’। প্র্যাকটিসিং আইনজীবীরা রিট করে বলেছেন, ‘নন–রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেটরা’ কেবল ভোটের বাজারের ফড়িয়া হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। বার নির্বাচন তার প্রতিনিধিত্বশীল বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে।
কর্মরত আইনজীবীদের সঙ্গে পেশা ত্যাগী বা ঘুমন্তদের একটা পার্থক্য টানা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সুপ্রিম কোর্ট বারের কক্ষ (কিউবিকেলস) বরাদ্দ নিয়ে অনেক সক্রিয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর দুঃখ–কষ্ট দীর্ঘদিনের। অনেক ব্যস্ততম সদস্য কক্ষ পান না। এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ১৮৬০ সালের সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায় একজন সহকারী রেজিস্ট্রারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি গুরুতর অনিয়ম দেখতে পায় এবং এর প্রতিকারের জন্য যে সুপারিশ করেছে, তা আমাদের দেশেও অনুসরণ করা চলে। এটা সম্ভব হলে কেবল ঢাকাভিত্তিক কেন্দ্রীয় বার কাউন্সিল নির্বাচনই নয়, দেশের ৮১টি বারের নির্বাচনই স্বচ্ছ ও প্রতিনিধিত্বশীল হবে। নির্বাচিত হওয়ার পরে ভুয়া সনদের অভিযোগে কারও কারও সদস্যপদ খারিজের ঘটনাও ঘটেছে।
তাই ওই তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে বলব, প্রতিবছর তালিকা হালনাগাদ হতেই হবে। এটা প্রকাশের আগে প্রতিবছর জুলাই মাসে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আইনজীবীরা তাঁদের পেশায় সক্রিয় থাকার জানান দেবেন। তালিকায় আইনজীবীর ছবিও মুদ্রিত হবে, যা বার কাউন্সিলের সচিব সত্যায়িত করবেন। আমাদের ইতিহাসে এই প্রথম একজন কর্মরত জেলা ও দায়রা জজকে প্রেষণে বার কাউন্সিলের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাঁকে এ দায়িত্ব দিতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
এলাহাবাদের রায়টি পড়ে আরও একটি ধাঁধা পরিষ্কার হলো। কে সক্রিয় আইনজীবী আর কে ঘুমন্ত আইনজীবী, তা নিরূপণের মানদণ্ড কী হবে। তালিকাভুক্তরা না হয় প্রতিবছর ঘোষণা দিলেন, চাঁদাও শোধ করলেন, কিন্তু কারা নন–প্র্যাকটিসিং আর কারা প্র্যাকটিসিং তা কী করে বুঝব। ওই তদন্ত কমিটি তারও একটি উপায় বাতলেছে এবং আশা করছি আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবীদের যাঁরা স্বচ্ছতার দাবি তুলেছেন, তাঁরা তা বিবেচনায় নেবেন। আর সেটা হলো: আইনজীবীরা তাঁদের পেশাগত বার্ষিক ঘোষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বছরে তাঁদের দ্বারা ওকালতনামা স্বাক্ষরিত মামলাগুলোর একটি তালিকা দেবেন। এরপর বার কাউন্সিল এই তথ্য হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে যাচাই করে নেবেন। আইনজীবী তাঁর মাসিক সদস্য চাঁদা তাঁর ব্যাংক হিসাবের অনুকূলে চেকে পরিশোধ করবেন। আয়কর রিটার্ন জমা দেবেন। এসব শর্ত পূরণ করে যাঁরা বার্ষিক বিবৃতি দিতে ব্যর্থ হবেন, তাঁদের সদস্যপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টাররা প্রতি ঘণ্টার প্র্যাকটিসের রেকর্ড সংরক্ষণ করেন। নবাগতদের জন্য প্রথম তিন বছরে ৪৫ সিপিডি (কন্টিনিউইং প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট) ঘণ্টার প্রাকটিস বাধ্যতামূলক। আর আমাদের দেশে অনেকে হাইকোর্ট বারে এনরোলড হয়ে রাঙামাটি কি পাথরঘাটায় গিয়ে প্র্যাকটিস করেন। তাঁদের নাম ফলকে ‘আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট’ দেখে মানুষ বিভ্রান্ত হন।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাঁর পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, বার কাউন্সিলে এনরোলড আছেন, কিন্তু আইন পেশায় নেই। কিংবা যিনি নিয়মিত প্র্যাকটিসে নেই, তাহলেও কি আদালতে তাঁর প্রবেশাধিকার থাকবে? না থাকবে না। কারণ, এনরোলড আইনজীবী মানে হলো তিনি দায়িত্ব পালনে যোগ্য, ব্যস এটুকুই। তাই এনরোলড হওয়া মানেই কোনো আদালতে তাঁর প্রবেশ অবাধ নয়।
২০০৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট নতুন বিধি করেছেন, যাঁরা সাধারণভাবে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন, তাঁদের মৌলিক তথ্যসংবলিত একটি তালিকা হবে প্রধান বিচারপতির তদারকিতে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করেছেন। আমাদের আপিল বিভাগের আইনজীবীদের জন্য এমন ব্যবস্থা কার্যকর আছে, হাইকোর্টেও দরকার।
বারে নাম লেখানো তো সারা জীবনের অক্ষয় পদবির ব্যাপার নয়। সংবিধানে ওই যে ১০ বছর বলা আছে, সেটা কীভাবে গণনা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু সুরাহা নেই। ইংল্যান্ডের রীতি ও এলাহাবাদ হাইকোর্টের ওই রায় অনুসরণ একটি দিশা দিতে পারে। দশ বিচারকের মামলায় বর্তমান প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ বেঞ্চ এই দশ বছর গণনা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। ওই বেঞ্চ সাফ বলেছিলেন, এই ১০ বছর ধরে শুধু নাম লিখিয়ে রাখলে চলবে না, প্র্যাকটিসিং চরিত্র সর্বদা বজায় রাখতে হবে।
সমগ্র ভারতে এ নিয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি হলে গত জানুয়ারিতে ভারতের বার কাউন্সিল তার বিধি সংশোধন করেছে। এই সংশোধনীতে প্রতিটি বারের জন্য প্রতিবছর ‘নন-প্র্যাকটিসিং লইয়ার্স লিস্ট’ প্রকাশ বাধ্যতামূলক করেছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বশীল তখনই বলা যাবে, যখন তারা শত শত ‘নন-প্র্যাকটিসিং’ সদস্যমুক্ত একটি ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নির্বাচন করতে সক্ষম হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.