বাংলাদেশ পাকিস্তান নয় by এম জে আকবর

এই সপ্তাহান্তে আমরা একটি ভুল ধারণার অবসান ঘটাতে পারি, যে ধারণাটি ১৯৪৭ সাল থেকে উপমহাদেশের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করছে। মুসলিম লীগ-ব্রিটিশ প্রকল্পে ভারত ভাগ হওয়ার পর থেকেই এটি জারি আছে। পাকিস্তান যে মুসলিম জাতি হিসেবে গড়ে উঠছে, সেটা ভারতের জন্য সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তান অতীতেও ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদে মদদ দিয়েছে, এখনো দিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রাথমিক নীতি ছিল ‘অন্য উপায়ে যুদ্ধ’, তা শিগগিরই ‘যেকোনো উপায়ে যুদ্ধের’ বৃহৎ কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। দেশটি ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ ছিল। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত বড়। লন্ডনের নিয়োজিত ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফ তাঁর অনভ্যস্ত হাতে যাচ্ছেতাইভাবে সীমানা চিহ্নিত করতে গিয়ে এই দেশভাগের ক্ষতকে আরও গভীর করে তুলেছিলেন।
এই সপ্তাহে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। এর ফলে কাশ্মীর সমস্যার সমবয়সী এক সমস্যার সমাধান হবে। অতি ব্যবহারের কারণে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দবন্ধটি ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে। তারপরও এই চুক্তির ব্যাপারে আমাদের সমীহ থাকা উচিত, এটা তার প্রাপ্য।
আমরা সফলতার ব্যাপারে হয় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি, না হয় নৈরাশ্যজনক হয়ে উঠি। আর খারাপ খবরে আমরা এত সম্মোহিত হয়ে যাই যে গণমাধ্যমও এতে মজে যায়। তারপরও প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এত দিল্লিকেন্দ্রিক যে আমরা ভুলেই যাই, ভারতে অন্যান্য প্রদেশও আছে। গণমাধ্যমে রাজধানীর পৌরসভার কোনো সমস্যা এত গুরুত্ব পায় যে বাংলার মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনাও তার তুলনায় সামান্যই গুরুত্ব পায়।
ঢাকা চুক্তির গুরুত্ব খাটো করা ঠিক হবে না। যে দেয়ালটির নির্মাণ ইট দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেটি পাথর হয়ে কংক্রিটে রূপ নিচ্ছিল, সেটি এখন ভেঙে পড়ছে। ভারত ও বাংলাদেশ তাদের অতীতকে পেছনে ফেলে আসতে পারলে পূর্বাঞ্চল নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজে নিতে পারবে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐকতানের মাধ্যমে।
অর্থনীতি রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু এটা বৈরিতা ভাঙতে পারে না। অর্থনৈতিক সফলতা সব সময়ই দ্রুতগতিতে অর্জিত হয়, আর সহযোগিতা থাকলে তা পেতেও কম মূল্য দিতে হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সমৃদ্ধি অর্জনের পথে স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সঙ্গী হতে পারে। কিন্তু শুধু বিশ্বাসের মাধ্যমেই অংশীদারি অর্জন করা যায়, আর বিশ্বাস গড়ে উঠতে পারে স্রেফ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের পথেও এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সেটি হচ্ছে, পূর্বাঞ্চলের পুনর্জাগরণ, এই অঞ্চল সমগ্র ভারত থেকে নানা কারণে পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পশ্চিম বাংলায় মার্ক্সবাদীদের ৩৫ বছরের শাসন। এই মার্ক্সবাদীদের চিন্তা বন্ধ্যা ও কাঠামোবদ্ধ, ফলে তারা কিছু করতে পারেনি। আর মোদি যেমন নীরবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বাধা টপকাচ্ছেন, তাতে তাঁর নেতৃত্বের গুণ প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মোদির আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন। তিনি বারবার বলেছেন, জনস্বার্থকে দলের রাজনীতির ওপরে স্থান দিতে হবে। সে কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঢাকা যাবেন। লড়াই হয়েছে নির্বাচনের সময়, কিন্তু সেটা শেষ হয়ে গেলে রাজ্য ও কেন্দ্র উভয়কেই ভারতের সেবা করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো সব হজম করে ফলতে পারে। তারা এই মানসিকতায় আটকা পড়েছে, যেমন কংগ্রেস ও বামপন্থীরা অনুর্বর ডিম ছাড়া আর কিছু পাড়তে পারে না। পররাষ্ট্রনীতি তত দূরই যেতে পারে, দেশের ভেতরের মতামত তাকে যত দূর নিয়ে যেতে পারে। ভারতীয়রা ঢাকার সঙ্গে চুক্তি করতে ইচ্ছুক, কিন্তু তারা ইসলামাবাদের ব্যাপারে খুব সতর্ক কেন?
রাষ্ট্রের মূলনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু জনগণের কাছে সবকিছু খোলাখুলি প্রকাশ করা হয় না বলে সেটা তাদের কাছে তেমন পরিষ্কার হয় না। শেখ হাসিনা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন, এটা ভারতীয়দের মনে ছাপ ফেলেছে। তিনি বিশ্বাসভিত্তিক রাজনীতিকে ধারণ করতে পেরেছেন, সন্ত্রাসবাদী চরমপন্থীদের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছেন।
এভাবে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছেন, আর সেটা উৎখাত করাও কঠিন হবে। এর বিপরীতে সন্ত্রাসবাদ ইসলামাবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, তা সেখানে যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্র তার জন্মের পরদিন থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকালে অবাক হতে হয়, দেশভাগজনিত মানবীয় দুর্ভোগ ও হঠাৎ জন্মের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ সত্ত্বেও দেশটির নেতারা সে পথ থেকে সরে আসেননি।
ক্ষমতায় আসার কয়েক দিন পরেই জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান রাজাশাসিত জম্মু ও কাশ্মীর অবৈধভাবে দখলের ষড়যন্ত্র করেন। সেই অভিযান শুরু হয় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, এখনো তা শেষ হয়নি। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ যখন বলেন, কাশ্মীর দেশভাগের এক অসমাপ্ত এজেন্ডা, তখন তিনি সেটা আরও নিশ্চিতই করেন। পাকিস্তান যদি জম্মু ও কাশ্মীরের সমস্যা মেটাতে যুদ্ধের পথ বেছে না নিত, তাহলে এই সমস্যার সমাধান আলোচনার টেবিলেই হতো। তারা ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই যোগ দেয়নি, আর যেহেতু ব্রিটিশ সংসদের আইনে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্যার সমাধান আলোচনার টেবিলেই হওয়া সম্ভব ছিল। পাকিস্তান এভাবে বহু বছরের জন্য শান্তির সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশ যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে। এটা পাকিস্তান থেকে স্রেফ ভৌগোলিক বিচ্ছেদ ছিল না, এটা আদর্শিক পরিবর্তনও ছিল বটে। এর ফলে বাংলাদেশ বিভিন্ন মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তার জাতীয় স্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে এগোতে সক্ষম হয়। ভারতের সঙ্গে তাদের ভিন্নতা আছে। তবে হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পর অনিঃশেষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে—দেশ দুটির মধ্যকার ভিন্নতা এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে নেই।
সবকিছু ঠিকমতো চললে ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে হাঁটবে এবং কাজ করবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া।
এম জে আকবর: ভারতীয় সাংবাদিক ও বিজেপির মুখপাত্র।

No comments

Powered by Blogger.