জলবায়ু চুক্তি নিয়ে দুর্ভাবনা by এম আসাদুজ্জামান

এ বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্যারিসে একটি জলবায়ু চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আশা করা হচ্ছে, সেখানে বিশ্বের মোটামুটি ১৯৪টি দেশ এ চুক্তির অধীনে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ একটি মেয়াদি ভিত্তিতে কমিয়ে আনবে, যাতে এ নিঃসরণের পরিমাণ ২১০০ সালের মধ্যে মোটামুটি বন্ধ বা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উষ্ণায়নের মাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে থাকবে।
একই সঙ্গে উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং অস্থিরতার জন্য যেসব বিরূপ অভিঘাত হচ্ছে বা হবে, তা অভিযোজন, অর্থাৎ স্তিমিত বা দূরীকরণে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর সঙ্গে এ জন্য যেসব প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা হস্তান্তর প্রয়োজন হবে, তা এবং অন্যান্য কারণে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে। সবশেষে কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক জোগানের ব্যবস্থা। এ চুক্তি ২০২১ সাল থেকে কার্যকর হবে এবং সে সময় থেকে বিশ্বব্যাপী এ জন্য প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার কোটি ডলার অর্থ জোগান হবে। কিন্তু এসবই নির্ভর করবে চুক্তিটি হবে কি হবে না, হলেও সেটা স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটা উপযোগী হবে, তার ওপর।
ইতিমধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জেনেভায় যে জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে, তাতে ওপরে উল্লিখিত চুক্তির একটা খসড়া পাওয়া গেছে। অন্যবারের মতো এ দলিলও বহু বিকল্পধারা, উপধারা, উপ-উপধারা এবং তৃতীয় ব্রাকেটে কণ্টকিত—গত ডিসেম্বরে লিমায় এটির প্রাথমিক খসড়া হয়, তখন এর আকার ছিল ২৮–২৯ পৃষ্ঠার মতো, তা বেড়ে হয়েছে ৯০ পৃষ্ঠা। একে মার্জিত রূপ দিতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে। আর মোটামুটি এক সপ্তাহের মধ্যে বন শহরে এটা পরিমার্জনের কাজ শুরু হবে। বাংলাদেশ ও তার মতো দেশগুলো এসব নিয়ে যদি পূর্ণ হুঁশিয়ার না থাকে, তাহলে তাদের স্বার্থরক্ষা কতটুকু হবে, বলা মুশকিল। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় অশনিসংকেত আছে। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলা দরকার।
১৯৬৯ সালে ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক চুক্তি-সংক্রান্ত একটি কনভেনশন হয় এবং ১৯৮০-৮১ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। সাধারণভাবে যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি এ কনভেনশনের কাঠামোয় হওয়ার কথা, তবে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো চাইলে সর্বসম্মতিক্রমে তার ব্যত্যয়ও হতে পারে। যাহোক, জেনেভায় যে খসড়া হয়েছে, তাতে সূচনায় ভিয়েনা কনভেনশনকে স্মরণ করা হয়েছে। এর অর্থ এই যে যদি এ ধারাটি টিকে যায় তবে যেসব দেশ এ চুক্তি স্বাক্ষর বা অনুমোদন করেনি, তারা সম্ভবত জলবায়ু চুক্তির আওতার বাইরে থাকবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তা হলে ওই চুক্তির আওতাধীন সহায়তা, অর্থপ্রাপ্তিসহ পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হবে না।
এখন পর্যন্ত ১১৪টি দেশ ভিয়েনা কনভেনশন সই করেছে—৪৫টি দেশ সই করলেও অনুমোদন করেনি। দ্বিতীয় গ্রুপে আছে যুক্তরাষ্ট্র; আর প্রথমটিতে আছে বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নরওয়ে এবং আশ্চর্যজনক হলেও ফ্রান্স, যে ফ্রান্সের নেতৃত্বে প্যারিসে চুক্তি হওয়ার কথা। এখন মোদ্দা কথা হচ্ছে যে ভিয়েনা কনভেনশনের ধারা যদি জলবায়ু চুক্তিতে বলবৎ থাকে, তবে কি বাংলাদেশ জলবায়ু চুক্তিটিতে সই করতে পারবে? সম্ভবত না এবং এটি একটি বড় দুর্ভাবনা।
তবে ভিয়েনা কনভেনশন সম্পর্কিত সমস্যা ছাড়াও আরও বড় সমস্যা আছে। জলবায়ু চুক্তির ধরন, তার বাস্তবায়নের পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে জেনেভা খসড়ায় একটা অংশ আছে। এবং তার এক জায়গায় বলা হয়েছে, কনভেনশনের যেসব পার্টি আইনগত বাধ্যবাধকতায় মিটিগেশন বা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে, কেবল সেসব কনভেনশনের পার্টিই জলবায়ু চুক্তিতে সদস্য হতে পারবে।
কথা হচ্ছে যে জলবায়ু কনভেনশন অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কোনো নিঃসরণ হ্রাসের দায়িত্ব নেই; পরবর্তী সময়ে বালি ও ডারবানে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিঃসরণ কমালেও তা সাধারণভাবে কনভেনশনের বা অন্যভাবে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় হবে। অর্থাৎ, নিঃসরণ হ্রাসের আইনি বাধ্যবাধকতা যদি থাকেও, তা হবে শর্তাধীন। কিন্তু ওপরের প্রস্তাবিত ধারায় কোনো শর্তের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ এ ধারা যদি টিকে যায়, তবে বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই ফাটা বাঁশের মধ্যে পড়বে। আইনি বাধ্যবাধকতায় নিঃসরণ কমানোতে রাজি না থাকলে চুক্তি সই করতে পারবে না। আর চুক্তি সই না করতে পারলে শর্তাধীন নিঃসরণ কমানোর কথা বলা যাবে না।
অবশ্য এ কথা ঠিক যে খুব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র কোনো আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে যেতে চাইছে না। কারণ, প্রেসিডেন্ট ওবামা রিপাবলিকান কংগ্রেসে তা অনুমোদন করাতে পারবেন না। আর ভারত যত দূর জানা যায়, অনুরূপভাবে অনাগ্রহী। এ দুটি বড় দেশ সই না করলে এ চুক্তির বিশেষ সার্থকতা থাকে না; তাতে খানিকটা সময় হয়তো পাওয়া যাবে। কারণ, প্যারিসে চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে।
সে যা-ই হোক, প্যারিসে না হলেও আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে চুক্তি হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা হবে। কিন্তু তার জন্য বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য জোর গলায় কথা বলতে হবে। যেখানে যেখানে প্রয়োজন, প্রতিটি বিকল্পধারা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দিতে হবে এবং কথা বলতে হবে, বিশেষ করে জলবায়ু চুক্তির সদস্য হওয়ার শর্ত নিয়ে। বাংলাদেশ সরকার কী এ জন্য প্রস্তুত?
এম আসাদুজ্জামান: প্রফেসরিয়াল ফেলো, বিআইডিএস।

No comments

Powered by Blogger.