আত্মীয়তার বন্ধনে রাজনীতি-১১, কাজী-মুন্সী পরিবার by কাফি কামাল

৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের দেশ বাংলাদেশ। আবহমানকাল ধরেই এদেশের মানুষ লড়াই করে আসছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। মোগল, বৃটিশ ও পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বারবার ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এ অঞ্চলের মানুষ বারবার রাজনৈতিক ঘেরাটোপে বন্দি ও সংগ্রামের মাধ্যমে সে বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর আদর্শগত পরিবর্তন হয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। এতে এককালে রাজনৈতিক মিত্র পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছে শত্রুতে। তবুও শেকড়ের মতো ছড়িয়ে রয়েছে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিকদের সামাজিক বন্ধন। অতীতের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়েও পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খানের পিতা আবদুল মোমেন খান ছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জিয়াউর রহমান সরকারের খাদ্যমন্ত্রী। ড. মঈন খানের সম্পর্কে জামাতা (ফুফাতো বোনের মেয়ের জামাই) হলেন বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার। আবার তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গে ত্রিমাত্রিক আত্মীয়তা রয়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বরকত উল্লাহ বুলুর। একদিকে তৈমূরের স্ত্রীর সম্পর্কে চাচা হলেন বুলু, আরেকদিকে বুলুর স্ত্রীর সম্পর্কে ভাই হলেন তৈমূর। এছাড়া, বুলুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ব্যারিস্টার রিদওয়ানের কাছে মেয়ে ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম খন্দকারকে বিয়ে দিয়েছেন তৈমূর। আবার তৈমূরের ছোট ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ হলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদল আহ্বায়ক ও নাসিকের কমিশনার এবং মেয়ে ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম খন্দকার শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শামীম ওসমানের ফুফা হলেন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কাজী পরিবারের সন্তান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদের পিতা কাজী মোজাফফর হোসেন ছিলেন গোপালগঞ্জ সাবডিভিশন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কাজী ফিরোজ রশিদের বেয়াই হলেন টঙ্গী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আজমত আলী খান। তিনি ফিরোজ রশীদের ছোট ছেলের শ্বশুর। গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি আবদুর রশীদ হলেন কোটালীপাড়ার কাজী পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আবার কাজী ফিরোজের চাচাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদ। তাদের ভাতিজি জামাই হলেন বিএনপি নেতা কাজী পান্নু। আর পান্নুর মামা হলেন বিএনপির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক ও ছাত্রদলের প্রথম আহ্বায়ক কাজী আসাদুজ্জামান।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও এরশাদ সরকারের সাবেক অর্থ উপমন্ত্রী এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সীর ছেলে হলেন বর্তমান সরকারের হুইপ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। ফখরুল ইসলাম মুন্সীর ভাই এএফএম তারেক মুন্সী জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা। ফখরুল মুন্সীর মামা হলেন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম গোলাম মোস্তফা। আবার ফখরুল মুন্সীর সঙ্গে কুমিল্লার বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীর সম্পর্ক হচ্ছে চাচাতো-জেঠাতো ভাইয়ের। মঞ্জুরুল মুন্সীর স্ত্রী মাজেদা মুন্সীও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় এবং ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে লড়েছেন। আবার গোলাম মোস্তফার ভায়রা হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী। তার আরেক ভায়রা হলেন সাবেক পরিকল্পনা সচিব নুরুল হুদা। আর ইনাম আহমেদের শ্বশুর ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এমআর খান। আর ইনাম চৌধুরীর ছোট ভাই সাবেক সচিব মাসুম চৌধুরীর শ্বশুর ও দুই চাচা শ্বশুর মনসুরুল আমিন, বদরুল আমিন ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ’র বাবা ফকির আবদুল মান্নান ছিলেন ঢাকা বারের প্রেসিডেন্ট ও পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী। হান্নান শাহ’র বোন জামাই মোহাম্মদ ইদ্রিস ছিলেন ঢাকা বারের প্রেসিডেন্ট। মোহাম্মদ ইদ্রিসের ভাতিজা হলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত জিল্লুর রহমান। বিএনপির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি সরকারের সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা খানম বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। সৈয়দ ওয়াহিদের সম্পর্কে ভাগনে হলেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। ইবরাহিমের চাচির ভাই হলেন ওয়াহিদ। আবার ইবরাহিমের শ্বশুর প্রয়াত সিরাজুদ্দীন ভূঁইয়া ছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ইবরাহিমের ভায়রা হলেন প্রয়াত মে. জে. (অব.) মতিউর রহমান বীরপ্রতীক। ইবরাহিমের মামা শ্বশুর গুলবক্স ভূঁইয়ার ছেলে সুলতান ভূঁইয়া ছিলেন এরশাদ সরকারের এমপি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফুফা হলেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী একে খন্দকার। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমানউল্লাহ আমানের ছেলের নানা শ্বশুর হলেন জিয়া সরকারের এমপি ঢাকার নবাবগঞ্জের আতাউদ্দিন খান। আবার চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসির বেয়াই হলেন এরশাদ সরকারের এমপি ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার আফসারউদ্দিন আহমেদ। হবিগঞ্জের বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়ার বেয়াই হলেন এরশাদ সরকারের সাবেক এমপি খলিলুর রহমান চৌধুরী। সুজাত মিয়ার মেয়ের শ্বশুর হলেন খলিল চৌধুরী।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব, এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন বাবলু। ডাকসুর সাবেক জিএস বাবলুর নানাবাড়ি হচ্ছে চট্টগ্রামে। একে খান তার চাচাতো নানা। বাবলুর মামা সেকান্দার হায়াত খান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও মামি জোবায়দা হায়াত খান এবং নানা সালেহ আহমেদ খান আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। বাবলুর আরেক মামা চৌধুরী হারুনুর রশীদ চট্টগ্রামের সাবেক এমপি ছিলেন। জিয়াউদ্দিন বাবলুর চাচাতো মামা হলেন বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী জহিরউদ্দিন খান ও খালাতো মামা হলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান। আবার চট্টগ্রামের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ও পাকিস্তান আমলের রাজনীতিক ও এমএলএ ব্যারিস্টার ডক্টর মোহাম্মদ সানাউল্লাহ হলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্র ও বর্তমান সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টি (জাফর) সভাপতি ও এরশাদ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের জামাতা হলেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজের সাবেক ভিপি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ইফতু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়ার নাতনী ও বর্তমান সরকারের হুইপ মাহবুব আরা গিনির স্বামী হলেন শাহ মাইনুল ইসলাম শিল্পু। তার বড় ভাই শাহ বদরুল ইসলাম সাজুর নানা শ্বশুর হলেন বাংলাদেশের প্রথম স্পিকার ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আবদুল হামিদ। গিনির ভাসুর শাহ বদরুল ইসলাম সাজু বিএনপির টিকিটে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সাজুর চাচাতো ভাই শাহ শরিফুল ইসলাম বাবলু গাইবান্ধা জেলা জাসদের সভাপতি। বাবলুর পিতা শাহ কফিলউদ্দিন ছিলেন পাকিস্তান সরকারের এমএলএ। আবার শাহ আবদুল হামিদের আরেক নাতি হলেন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাগীব হাসান চৌধুরী হাবুল।
বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি হাসানউদ্দিন সরকারের বড় দাদা নিজামউদ্দিন সরকার ছিলেন টঙ্গী ইউনিয়ন বোর্ডের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান। তার একই সঙ্গে চাচাতো ভাই ও মামাতো বোনের জামাই হলেন গাজীপুর জেলা বিএনপি নেতা ও টঙ্গীর সাবেক পৌর মেয়র সালাহউদ্দিন সরকার। তার আরেক চাচাতো ভাই সাহাজউদ্দিন সরকার ছিলেন টঙ্গী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান। হাসান সরকারের বড় ছেলের শ্বশুর হলেন ত্রিশাল পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ। আবার হাসান সরকারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেন টঙ্গীর সাবেক এমপি কাজী মোজাম্মেল।
অন্যদিকে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ের জামাই হলেন স্বাচিপ নেতা ডা. আরিফ। কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম বেবু, শহীদুজ্জামান সাজু ও মহিলা দলের আহ্বায়ক রেহেনা খান হলেন ভাইবোন। তাদের সম্পর্কে জামাতা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক মীম নাজমুল ক্রাউন। বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য জেবা রহমানের পিতা ঝালকাঠির ব্যারিস্টার আক্তার হোসেন ছিলেন মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা। আর জেবা রহমানের শ্বশুরপক্ষীয় ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি নাজমুল হাসান জাহেদ ও বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন।

No comments

Powered by Blogger.