বাংলাদেশী কিশোরের বর্ণনায় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নির্মমতা

চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের দুই কিশোর। তাদের চোখেমুখে হতাশা। পরনে ময়লার আস্তরণ পড়া পোশাক। ক্লান্ত শরীরে হাঁটার শক্তি নেই তাদের। দুর্বল হওয়ায় পাচারকারীরা ফেলে গেছে তাদের। লুকাতে চেয়েও পারে নি তারা। ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। তারা বলেছে, ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। নিয়মিত নির্যাতন করা হয় বন্দিদের। মুক্তিপণ দিতে না পারলে তার মাত্রা আরও বেড়ে যেত। এমন নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। এমন মৃত্যু চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে তারা। ওই দুই কিশোরের একজনের বয়স ১৫ বছর। তার বাড়ি মিয়ানমারের সিতওয়েতে। অন্যজন চট্টগ্রামের। তার বয়স আরও কম। তবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয় নি। তারা বলেছে, পাচারকারীদের হাতে বন্দিদের জীবনের করুণ অধ্যায় সম্পর্কে। বলেছে, পুলিশ যখন কোন বন্দিশিবির ঘেরাও দেয় তখন তাদের দৌড়ে পালাতে হয় অন্য ক্যাম্পে। এ ক্ষেত্রে যাদের গায়ে শক্তি নেই তারা পেছনে পড়ে থাকে। দুর্বল এসব মানুষের ভাগ্যে পরে কি ঘটে তা কেউ বলতে পারে না। বন্দিশিবিরে পড়ে থাকে জিম্মি রাখা মানুষের মৃতদেহ। কখনও তাদের সমাহিত করা হয়। কখনও ওই অবস্থায় ফেলে যায় পাচারকারীরা। গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা এমনই একটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই মৃতদেহটি পরিণত হয়েছে কংকালে। সেই কংকাল পুলিশকে সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। গতকাল ওই কংকালের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন মিজিমায়। এ কংকাল কোন দেশের নাগরিকের তা-ও কেউ বলতে পারে না। গতকাল এ খবর দিয়েছে অনলাইন ব্যাংকক পোস্ট ও মিজিমা। এতে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের কথা। তাতে প্রকাশিত ২৬টি মৃতদেহ যে গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তার ছবি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে একটি কবরের ছবি। সেটি ততটা গভীর নয়। তা খননের পর তার ভেতর দেখা যাচ্ছে মৃতদেহের কংকাল। গত শুক্রবার একটি গণকবরের সন্ধান মেলার পর পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। তারা ওই গণকবরে কমপক্ষে ২৬টি মৃতদেহ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের নাগরিকের লাশ। পাচারকারীদের হাত থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে কোন মতে রক্ষা পেয়েছেন রহিমা খাতুন (২৫) নামে এক নারী। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশী ওই কিশোরের কাহিনীর সঙ্গে রহিমা খাতুনের দেয়া বর্ণনা মিলে যায়। ওই জঙ্গলে পুলিশ দ্বিতীয় আরও একটি বন্দিশিবিরের সন্ধান পেয়েছে। তবে সেখান থেকে কোন মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে কিনা তা জানা যায় নি। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মানব পাচারবিরোধী যে অভিযান এখন জোরদার হয়েছে, তাতে বিপন্ন হতে পারে পাচারকারীদের হাতে আটক মানুষগুলোর জীবন। কারণ, তাদের ঠিকমতো খাবার দেয়া হয় নি। রোগে ওষুধ দেয়া হয় নি। উল্টো আত্মীয়স্বজনরা মুক্তিপণ দিতে না পারায় তাদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতন। এতে অনেকে মারা গেছেন। যারা জীবিত আছেন তাদের গায়ে কোন শক্তি নেই। চোখেমুখে শুধুই হতাশা। যখনই কোন বন্দিশিবির যাকে ক্যাম্প হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেখানে পুলিশ অভিযান চালায় তখনই পাচারকারীরা বন্দিদের নিয়ে দ্রুত সরে পড়ে পার্শ্ববর্তী আরেকটি ক্যাম্পে। এ ক্ষেত্রে যাদের গায়ে শক্তি নেই, মরণদশায় উপনীত তাদের পেছনে ফেলে রেখে যায় পাচারকারীরা। ফেলে যাওয়া ওইসব মানুষের ভাগ্যে কি ঘটে, তাদের শেষ পরিণতি কি সে খবর আর কেউ রাখে না। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাচারবিরোধী এ অভিযানের ফলে ঘটনার শিকার মানুষগুলোর জীবনে নেমে আসছে নতুন করে আরেক ভীতি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওই দুই কিশোর বলেছে, পুলিশ যখন প্রথম ক্যাম্পে হানা দেয় তখনই পাচারকারীরা সেখান থেকে সটকে পড়ে। সঙ্গে নিয়ে যায় জীবিত বন্দিদের। এ ক্ষেত্রে তারা পেছনে ফেলে যায় অনেক মৃতদেহ আর প্রচণ্ড রোগাক্রান্ত, দুর্বল দু-চারজন বন্দিকে। জীবিত সেই দু-চারজনের দুজন হলো এই দুই কিশোর। এ ঘটনায় পাচারবিরোধী অভিযানে আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। এর মধ্যে রয়েছে একডজনেরও বেশি সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তা। ব্যাংকক পোস্ট লিখেছে, প্রতি বছর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বাংলাদেশী মিলে হাজার হাজার মানুষকে বিদেশে কাজ দেয়ার নাম করে পাচার করা হয়। উত্তাল সমুদ্রপথে তারা পাড়ি জমায়। তারপর একসময় পৌঁছে যায় থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে। এ এলাকাটি পাচারের সবচেয়ে সুপরিচিত একটি রুট। কখনও কখনও নিয়ে যাওয়া হয় মালয়েশিয়ার দক্ষিণ দিকে। তাদের আটকে রাখা হয় বিভিন্ন গোপন ক্যাম্পে। এর পর আত্মীয়স্বজনের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সম্প্রতি যেসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে তাতে মানবাধিকার কর্মীরা ‘থ’ বনে যাচ্ছেন। তাদের ধারণা, থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে এ রকম আরও অনেক ক্যাম্প থাকতে পারে। প্রথম যে গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে পাচারকারীরা সেখানে ফেলে গেছে দুজন বন্দিকে। তাদের দেহে তখন কোন মতে শ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে পড়ে আছে বাকিদের মৃতদেহ। এর মধ্যেও বাংলাদেশী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মৃতদেহের মধ্যে কোন কোন দেশের নাগরিক এবং কতজন ছিল তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে থাইল্যান্ডের পুলিশ বলেছে, তারা মৃতদেহগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে শনাক্ত করার চেষ্টা করবেন তাদের পরিচয়। ওদিকে আরাকান প্রজেক্টের ক্রিস লিওয়া বলেছেন, কয়েক মাস ধরে ঘেরাও অভিযান চলছে। অভিযান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাচারকারীরা তাদের ক্যাম্প পরিবর্তন করে। অধিকতর দুর্বলদের তারা ফেলে যায় গহিন জঙ্গলে। এসব মানুষের পরিণতি নিয়ে মোটেও ভাবে না তারা। ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যু এসে হানা দেয়। থাইল্যান্ডের সংখলা এলাকায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করে ইয়ং মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব থাইল্যান্ড। এর কর্মী আবদুল আজিজ কাদেইন বলেন, পাচারকারীরা খুব দ্রুত তাদের রুট পরিবর্তন করে নতুন রুট বের করে। এ ক্ষেত্রে তারা থাইল্যান্ডে না এসে রুট পরিবর্তন করে সরাসরি চলে যায় মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার দিকে। থাইল্যান্ড দীর্ঘদিন পাচার বিষয়ে চোখ বন্ধ করে আছে বলে অভিযোগ বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপের। তবে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর পিস অ্যান্ড অর্ডার বলেছে, এখন উপযুক্ত সময় এসেছে। যদি কোন সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাও এ পাচারের সঙ্গে জড়িত হন, তাহলে তাকেও কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তাদের পদ, পদবি এ ক্ষেত্রে কোন বিবেচ্য নয়। এ ক্ষেত্রে গত মাসে থাইল্যান্ডকে হুমকি দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তারা বলেছে, যদি শ্রম দাস, নৌপথে মানব পাচারসহ সব অবৈধ চর্চা বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ না নেয় তাহলে তাদের সমুদ্রজাতীয় খাদ্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আধুনিক দাসপ্রথা মোকাবিলায় থাইল্যান্ডকে একেবারে নিচের সারির দেশে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।

No comments

Powered by Blogger.