কলেজশিক্ষক লাঞ্ছনা জাতির লজ্জা by পুলক চাকমা

কয়েক দিন আগে এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন পিরোজপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে পুরো শিক্ষা ক্যাডারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ভান্ডারিয়া সরকারি কলেজে প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত একজন জুনিয়র কর্মকর্তা এবং ওই কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের মধ্যে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি থেকে ওই শিক্ষকের সঙ্গে যে অমর্যাদাকর ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়েছে, তাতে শুধু দেশের শিক্ষকসমাজ তথা বিবেকবান মানুষের মাথা হেঁট হয়নি, একই সঙ্গে যারা অনেক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত বিভিন্ন সার্ভিসে স্ব স্ব বিভাগে চাকরি করছি, তঁাদের সবার জন্য বিষয়টি বিব্রতকর।
যখন সবার প্রচেষ্টায় দেশের শিক্ষা শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, হরতাল, অবরোধ, রাজনৈতিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সময়মতো ছাত্রছাত্রীদের কাছে বই পৌঁছানো, প্রতিকূল পরিবেশে পাবলিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার চেষ্টায় পুরো জাতি স্বস্তি অনুভব করছে, তখনই এ ধরনের ঘটনা পুরো শিক্ষা পরিবারকে ভাবিয়ে তুলেছে সন্দেহ নেই। রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। যে যে বিভাগে বা পদের দায়িত্বে থাকি না কেন, আমরা কেউ কারোর প্রতিপক্ষ নই। অসহিষ্ণুতা বা দ্বন্দ্বের মাধ্যমে নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে সুষ্ঠু সেবানির্ভর মানবিক প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যতম লক্ষ্য।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আওতায় ২৭টি ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বড় ক্যাডারটি হলো শিক্ষা ক্যাডার। এ শিক্ষকসমাজের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধা, নেতৃত্ব, সৃষ্টিশীলতা গড়ে ওঠে। শিক্ষকসমাজ সারা জীবন নিরলসভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিবিষ্ট থাকেন। কলেজশিক্ষকেরা ক্যাডারভুক্ত হলেও অন্যান্য ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের মতো নির্বাহীÿ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। রাষ্ট্র যে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করেছে, সেটি মূলত আইনশৃঙ্খলাসহ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার জন্য, কারোর ব্যক্তিগত খায়েশ মেটানোর বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলনের জন্য নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখলাম, নির্বাহী ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যেভাবে একজন শিক্ষককে সবার সামনে হেয় করলেন, এতে কেবল শিক্ষকসমাজই নয়, দেশের সচেতন সমাজ রীতিমতো স্তম্ভিত! যে কর্মকর্তা আরেক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে সম্মান দিতে সক্ষম নন, তিনি কীভাবে জনগণের সেবা করবেন! অথচ সংবিধানে ২১(২) অনুযায়ী সব সময় জনগণের সেবা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য বলে উল্লেখ রয়েছে।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে প্রভুসুলভ মানসিকতা প্রকটভাবে কাজ করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট আশ্রাফুল ইসলাম সহকারী অধ্যাপককে সবার সামনে অপমান করে হয়তো তাঁর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার দাপট দেখাতে চেয়েছিলেন এবং তিনি দেখাতে পেরেছেন সন্দেহ নেই! কিন্তু এ ঘটনার পর তাঁর মনে কি কোনো উপলব্ধি এসেছে, কাজটি আদৌ সঠিক হলো কি না?
যেখান থেকে এ ঘটনার সূত্রপাত তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেট আশ্রাফুল ইসলাম সেলফোনে কথা বলতে বলতে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি অপরিচিত কোনো ব্যক্তির এ রকম প্রবেশে তাঁর পরিচয় জানতে চাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে আশ্রাফুল সাহেবের এত আত্মসম্মানে লাগল কেন বোধগম্য নয়। তিনি পরীক্ষা কেন্দ্রে যেভাবে প্রবেশ করেছেন, সেটিও মোটেই গ্রহণযোগ্য আচরণ ছিল না।
যাহোক পূর্বপরিচিতি না থাকায় দুজনের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এটি নিজেদের মধ্যে কিংবা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মধ্যস্থতায় সুন্দরভাবে মীমাংসা হতে পারত। অন্যদিকে নির্বাহী কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষ যদি দক্ষ হতেন, তাহলে ঘটনাস্থলে সম্মানজনক সমাধান হতে পারত কিন্তু তা না হয়ে ÿক্ষমতার দাপট প্রদর্শন করতে গিয়ে পরবর্তীকালে যে ঘটনার উদ্ভব হয়, তা মোটেও দায়িত্বশীলতার মধ্যে পড়ে না। ফৌজদারি মামলার ও সামারি ট্রায়ালের নামে পুলিশ ডেকে হ্যান্ডকাফ পরানো কিংবা সাংবাদিক ডেকে পা ধরে ÿক্ষমা চাইতে বাধ্য করার চিত্র সামাজিক মাধ্যমসহ মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়ে প্রকৃত অর্থে সমগ্র শিক্ষকসমাজকে অপমানই করা হয়নি, ক্ষমতাপ্রাপ্ত (?) কিছু কর্মকর্তা যে অন্যদের কীভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন, তাও আরেকবার পরিষ্কার হলো। যে কর্মকর্তা একজন কলেজশিক্ষকের সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রে তাঁর ক্ষমতার দাপট দেখানোতে বাহাদুরি খুঁজে পান, তাঁর কাছ থেকে পাবলিক সেবা কতটুকু মসৃণ হবে, তা সহজে অনুমেয়।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি আমাদের কাজের ধরন বা ক্যাডার ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আমরা কেউ কারোর প্রতিপক্ষ নই। এখানে প্রভুত্ব বা ক্ষমতা জাহির করারও অবকাশ নেই। যে কর্মকর্তা ন্যূনতম সৌজন্যমূলক আচরণগুলো এখনো আয়ত্ত করতে পারেননি, তিনি যে বিভাগেরই প্রতিনিধিত্ব করুন না কেন, সে বিভাগের সুনাম বিনষ্ট করবেন এবং তাঁর দায়ভার তাঁকে বহন করতে হবে। আমরা যদি সিনিয়রিটির বিচারেও দেখি তাহলে জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট (২৯ ব্যাচ) সহকারী অধ্যাপকের (২৪ ব্যাচ) একজন জুনিয়র কর্মকর্তা।
পরিশেষে বলতে চাই, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ যেমন কারোর কাম্য নয়, তেমনি আমরা মনে করি সহকারী অধ্যাপককে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেভাবে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে মানসিক ও সামাজিকভাবে অপমানিত করা হয়েছে, সে জন্য দায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে অবিলম্বে তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা চাই, সব ক্যাডার কর্মকর্তা নির্লোভ, নির্মোহ, সমমর্যাদার ভিত্তিতে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুক এবং উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গঠনে ভূমিকা রাখুক।
পুলক চাকমা: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা।
pulakchakma21@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.