কাঁটাতারে নির্মিত সেলে চলতো নির্যাতন

মালয়েশিয়ার বন্দিশিবিরগুলোও ছিল নির্যাতনের সেল। কাঠ আর কাঁটাতার দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সেসব সেল। এমন সেলকে মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান খালিদ আবু বকর ‘হিউম্যান কেজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওই কাঁটাতারের বেষ্টনী থেকে যাতে পাচারকারীদের শিকার বাংলাদেশী অথবা মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা পালাতে না পারেন সেজন্য বসানো হয়েছিল প্রহরা। এ অবস্থা দেখে ভীষণ মর্মাহত খালিদ আবু বকর। ওদিকে যেসব বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়া তাদেরকে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অভিবাসন বিষয়ক পরিচালক মির্জা ইস্কান্দার বলেছেন, সব বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়ায় ইন্দোনেশিয়া তার সর্বোত্তম সেবা দেবে। বন্দিশিবিরের ওই সেলগুলো সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কাঠের তৈরি এসব খোঁয়াড় তৈরি করা হয়েছিল বন্দিদেরকে আটকে রাখার জন্য। সেখানে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। বন্দিদের স্বাধীনতা বলতে ওই খোঁয়াড়ের মধ্যেই চলাফেরা সীমিত ছিল। তারা যাতে পালাতে না পারেন সেজন্য পাচারকারীরা বসিয়েছিল চেক পোস্ট। যেসব বন্দিশিবিরে এসব নির্যাতন সেল  পাওয়া গেছে, তা সদ্য আবিষ্কৃত ১৩৯টি গণকবরের কাছেই। তবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আর কিছু বলেন নি। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বলেছে, গহিন জঙ্গলে ওই সব ক্যাম্পে বন্দিদের জিম্মি করে মুক্তিপণ চাওয়া হতো। যারা দিতে পারেন নি তাদের ওপর নির্যাতন করা হতো। তার ফলে যারা মারা গিয়েছেন তাদেরকে গণকবরে সমাহিত  করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মানুষ নৌপথে থাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়া পৌঁছার চেষ্টা করেছে। তাদের বেশির ভাগই দালালদের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। পাচারবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ার খবর শুনে পাচারকারীরা তাদেরকে ফেলে পালিয়েছে। ফলে সমুদ্রের মাঝে খাদ্য, পানি, ওষুধবিহীন এক অবর্ণনীয় অবস্থার শিকার হয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা। খাবার নিয়ে বাংলাদেশী মুসলিম ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। তাতে নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। নৌকা থেকে জীবিত মানুষ ফেলে দেয়া হয়েছে সমুদ্রে। জাতিসংঘের হিসাবে সাগরে ভাসমান প্রায় ৮ হাজার অভিবাসীকে উদ্ধারে ওই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া তাদের জলসীমায় এসব অভিবাসীকে নিয়ে পিং পং খেলা শুরু করে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই তিন দেশ গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে বৈঠক করে অভিবাসীদের শর্তসাপেক্ষে ঠাঁই দিতে সম্মত হয়। তারপর থেকে বড় ধরনের কোন উদ্ধারের কথা শোনা যায় নি। তবে এরই মধ্যে মালয়েশিয়াতে ১৩৯টি গণকবর ও কমপক্ষে ২৮টি বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়ায় বেরিয়ে আসতে থাকে পাচারের সময় নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য। সে কথাই বর্ণনা করলেন মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান খালিদ আবু বকর।
থাইল্যান্ড উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে: সমুদ্রে ভাসমান মানুষগুলোকে সহায়তা দেয়া শুরু করেছে থাইল্যান্ড। তাদের নৌবাহিনীর রিজিওন ৩-এর একটি জাহাজ এবং রয়েল থাই এয়ার ফোর্সের একটি বিমান প্রাথমিকভাবে এ অভিযান শুরু করেছে। এ অভিযান চলবে দু’সপ্তাহ। তবে প্রয়োজন হলে এর সময়সীমা আরও বাড়ানো হবে। রিজিওন ৩ এর নৌ কমান্ডার ভাইস এডমিরাল সায়ান পাসোঙ্গসামরেট বলেন, এ অভিযানের উদ্বোধন করা হয়েছে ফুকেট প্রদেশে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে। এ জাহাজকে সিমিলান দ্বীপ থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল পশ্চিম পর্যন্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে তাদের মোট ৭টি জাহাজ ও নৌযান মোতায়েন করা হলো। এতে যোগ দিয়েছে উদ্ধারকারী দুটি বিমান ও দুটি হেলিকপ্টার। সম্মিলিতভাবে এ অভিযানে রয়েছে ৬০০ প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা। এ অভিযানে আকাশপথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী ভূমিকা রাখবে গ্রিপেন যুদ্ধজাহাজ উইং ৭। তবে তারা ভাসমান মানুষকে উদ্ধার করবেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান ওচা ভাসমান অভিবাসীদের মানবিক সহায়তার নির্দেশ দেয়ার পরই গতকাল শুরু হলো এ অভিযান।
বাংলাদেশী অভিবাসীদের শিগগিরই ফেরত পাঠাবে ইন্দোনেশিয়া: ওদিকে সম্প্রতি সাগর থেকে যেসব বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়েছে দ্রুততম সময়ে তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে ইন্দোনেশিয়া। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সম্মতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তা মির্জা ইস্কান্দার। তবে বাংলাদেশী অভিবাসীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছেন ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় প্রসিকিউটর প্রধান এআর মিফতাহুল আরিফিন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা এখনও বিস্তারিত জানি না। এসব বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে নিতে ভাড়া করা বিমান নাকি বাণিজ্যিক বিমান ব্যবহার করবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস আমাদেরকে জানায়নি। তবে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর আগে পাঠানো হবে মেদান ও উত্তর সুমাত্রায়। ইন্দোনেশিয়া থেকে অভিবাসীদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোন মন্তব্য করে নি বাংলাদেশ সরকার।
মিয়ানমারও অভিবাসীদের ফেরত পাঠাবে: ওদিকে গত শুক্রবার মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পশ্চিমে ভাসমান একটি নৌযান থেকে ২০৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করে মিয়ানমার। এর মধ্যে ২০০ জন বাংলাদেশী বলে রিপোর্ট দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস। তাতে বলা হয়েছে, ওই বাংলাদেশীর মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকার উত্তরাঞ্চলের মানুষ। বাকি ৮ জন হলো রাখাইন প্রদেশের বাংলাভাষী। ওই বোট থেকে উদ্ধার করা মোহাম্মদ মুফাজল হুসেইন বলেন, তিনি শুধু কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তাকে জোর করে দুজন ব্যক্তি নৌকায় তুলে নেয়। তারা আমাকে বলে যে, আমাকে কিনে নিয়েছে তারা। তারা আমাকে নৌকায় তুলে নিয়ে ছুটতে থাকে থাইল্যান্ডের দিকে। দাবি করা হয় ৫০ হাজার করে টাকা।
ইন্দোনেশিয়ানদের হৃদ্যতা: ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে গড়ে উঠেছে এসব অভিবাসীর অস্থায়ী আবাস। সেখানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ছেলেমেয়েরা এখন একটু জীবনের স্পর্শ পেয়েছে। কুয়ালা লাঙসা ক্যাম্পে রয়েছে চারটি আশ্রয়শিবির। সব মিলে সেখানে ঠাঁই পেয়েছেন ১৭ শতাধিক মানুষ। ইন্দোনেশিয়ার একটি মুসলিম সংগঠন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা শিশুদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছে। কেউ বা দিচ্ছে আইসক্রিম। তা খেয়ে অনেক শিশু বলেছে, তারা জীবনে এত স্বাদের আইসক্রিম খায় নি। জাতিসংঘের শরণার্থী  বিষয়ক হাই কমিশনার ১৮ বছরের কম বয়সী ১৬০টি শিশুকে শনাক্ত করেছে। তারা নিঃসঙ্গ। কোথায় তাদের পিতামাতা বলতে পারে না। আচেহতে যে পরিমাণ অভিবাসী আছেন তার এক তৃতীয়াংশই শিশু।

No comments

Powered by Blogger.