গভীর জলের ফিশ by শামীমুল হক

গভীর জলের ফিশ। মানে অতি চালাক। যাকে ধরা খুব কঠিন। ছোঁয়াও কঠিন। গভীর জলে থেকে তারা জেলেকে লেজ দেখায়। মিটিমিটি হাসে। মানুষের মধ্যেও এমন গভীর জলের ফিশ চরিত্র রয়েছে। যারা নিজেকে চতুর মনে করে। সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে। আর মনে মনে ভাবে আমি যে এত চতুর কেউ তা বুঝতেই পারে না। এটা ভেবে তিনি আত্মতৃপ্তি পান। গ্রামে গঞ্জে, শহরে-বন্দরে এমন গভীর জলের ফিশের সংখ্যা এখন হাজারে হাজার। যাদের দেখলে, যাদের কথা শুনলে লজ্জায় শ্রোতাদের মাথা নিচু হয়ে আসে। কিন্তু তাদের মাথা উঁচুই থাকে। কোন বিষয়ে নিজ স্বার্থে এমন কথা বলেন, যা কিনা একেবারেই অযৌক্তিক। অথচ এ অযৌক্তিক কথাকে সত্য প্রমাণ করতে নানা উদাহরণ হাজির করেন। মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায়, তিনি যে সব উদাহরণ হাজির করলেন- তাতে তার কথা তারই বিপক্ষে যায়। তারপরও তিনি ঠেলে যাবেন নিজের কথার পক্ষে। ইদানীং দু’-একটি টিভি চ্যানেল দেখলে এমন গভীর জলের ফিশদের দেখা যায় সহাস্যে। হায় রে নিয়তি! চ্যানেলগুলোতে দু’পক্ষের লোকজনকে হাজির করে মুখোমুখি। একের পর এক বিষয় অবতরণ করেন উপস্থাপক। তারপর আর যায় কোথায়? দু’পক্ষই একসঙ্গে শুরু করেন লড়াই। কে কাকে দোষ দিতে পারবেন, কে কাকে কতটুকু ঘায়েল করতে পারবেন- চলে এর কসরত। এ অবস্থায়ই একপর্যায়ে উপস্থাপক তার অনুষ্ঠান শেষ করেন তড়িঘড়ি করে। এখানে গভীর জলের ফিসের ভূমিকায় থাকে দু’পক্ষই। শুধু টকশোতে কেন সব জায়গায়ই আজ গভীর জলের ফিশদের দাপট। মার্কেটে যাবেন? সেখানেও দেখবেন বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়েই গভীর জলের ফিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শেষ পর্যন্ত ক্রেতা মনে করেন নিজে সফল মালামাল বিক্রি করতে পেরে। আর বিক্রেতা মনে করেন তিনি সফল মালামাল কিনতে পেরে। বিক্রেতা ভাবেন ভাল লাভ হয়েছে। ক্রেতাও ভাবেন অনেক কম দামে কিনেছি। তবে রাজনীতিতে গভীর জলের ফিশের অভাব নেই। কেউ কেউ একাধারে নিজ দলের পক্ষে অযৌক্তিকভাবে গলা ফাটিয়ে নিজেকে গভীর জলের ফিশ প্রমাণিত করেন। আবার কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নিজেকে গভীর জলের ফিশ ভাবেন। আবার কেউ নিজ দলকে ভাঙিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন। কেউ ভৃত্য থেকে হন জমিদার। কেউ নিঃস্ব থেকে হন কোটিপতি। কেউ কেউ হ্যাংলা থেকে হন মোটা-তাজা। কেউ বা নেতাকে পুঁজি করে হন সমাজের হর্তাকর্তা। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করেন। তাদের আঙুলি হেলনে সমাজ চলে। তাদের হুঙ্কারে সমাজ থরথর করে কাঁপে। বেলা শেষে এর দায়ভার নিতে হয় দলকে। নেতাকে। আসলে রাজনীতিতে গভীর জলের ফিশরাই সবসময় বিপদ ডেকে আনেন। তারাই নেতাকে ভুল বুঝিয়ে কঠিন বিপদের দিকে ঠেলে দেন। শেষ মুহূর্তে যখন নেতা বিপদে পড়েন তখন আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দেখা যায় ততক্ষণে তারা অনেক দূরে চলে গেছেন। হয়তো দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। নেতা তখন ভীষণ বিপদে। বিপদের দিনে এগিয়ে আসেন সুসময়ে যারা দূরে ছিলেন তারা। নেতাকে আগলে রাখেন। রোদ থেকে বাঁচাতে ছায়া দেন। বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে মাথায় ছাতা ধরেন। এ অবস্থায় দেখা যায় নেতা যখন দীর্ঘ সংগ্রাম করে বিপদ কাটিয়ে এগিয়ে গেছেন তখন কোথা থেকে যে সামনে এসে হাজির হন গভীর জলের ফিশরা তা টেরই পাওয়া যায় না। আবার তারা ঠিকই তাদের জায়গা করে নেন নেতার পাশে। দুঃসময়ে যারা কাছে ছিলেন সুসময়ে তারা কখনই কাছে আসতে পারেন না। তারা গুমরে মরেন। কিন্তু তাদের কিছুই করার থাকে না। নেতাও তাদের মনে রাখেন না। শুধু রাজনীতিতে কেন? সবক্ষেত্রেই চলছে আজ এ অবস্থা। গভীর জলের ফিশরা সব সময় তক্কে তক্কে থাকে। ঝোপ বুঝে কোপ মারে। সব নীতিকেই তারা দূরে ঠেলে সেখানে কায়েম করে দুর্নীতি। আফসোস হলো তাদের চিনেও কেউ কিছু করতে পারে না। তাদের কাছে কোথায় যেন জিম্মি। এ কারণেই দেখা যায় সারাজীবন মাঠের রাজনীতি করে কেউ সংসদে যেতে পারেন না। কিন্তু পয়সার জোরে রাজনীতি না করেও কেউ কেউ দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়ে যাচ্ছেন। দাবড়ে বেড়াচ্ছেন রাজনীতির ময়দান। রাজনীতিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন। গভীর জলের মাছ তাদের না বলে কাদের বললে ভাল হবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গোটা দেশটাই যেন গভীর জলের ফিশের কবলে পড়ে গেছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন করতে পেরে কেউ কেউ নিজেদের গভীর জলের ফিশ ভাবছেন। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়েও কেউ কেউ নিজেকে ভাবছেন গভীর জলের ফিশ।

No comments

Powered by Blogger.