আসুন, আমরা সবাই এরশাদ হই! by সোহরাব হাসান

লাগ ভেলকি লাগ। একদা জনগণ দ্বারা পরিত্যক্ত এবং হালে জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্বারা অভিষিক্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখন দলের নেতা-কর্মী দ্বারাই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। ক্ষমতায় থাকতে তাঁকে বলা হতো সিএমএলএ বা ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। অর্থাৎ আমার আগের ঘোষণাটি বাতিল করা হলো। রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে এখন অ্যানাউন্সমেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই বলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একেক দিন একেকজনকে বহিষ্কার করেন। জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতা ও তাঁর স্ত্রীকেও তিনি একাধিকবার দল থেকে বহিষ্কার করেছেন এবং নিজে ঘর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

কয়েক দিন আগে এই সাবেক সামরিক শাসক ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিএনপি জাতীয় পার্টিতে বিলীন হয়ে যাবে। তাঁর দলই হবে প্রধান বিরোধী দল। এরপর বললেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, আগামী নির্বাচনে তাঁর দলই ক্ষমতায় আসবে। এখন দেখা যাচ্ছে, তাঁর জাতীয় পার্টিতে গৃহদাহ শুরু হয়েছে। নেতায় নেতায় ঝগড়াঝাঁটি, গালমন্দ সমানতালে চলছে। এরশাদ সাহেবের দলে যতজন মহাসচিব ছিলেন, তাঁদের সবার ঠিকুজি খুঁজে বের করতে গবেষণার প্রয়োজন হবে। মহাসচিব আসে–যায়, চেয়ারম্যান তিনিই থাকেন।
একটি রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শগতভাবে কতটা দেউলিয়া হতে পারে, কতটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এরশাদের জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে যে নেতৃত্বের সংকট, তার মূলে এরশাদের স্বৈরাচারী মনোভাব এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাঁর দ্বৈত ভূমিকা। একটি দল বা একজন নেতা নির্বাচনের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ভালো হোক মন্দ হোক, তাঁকে একটি সিদ্ধান্তই নিতে হয়। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এরশাদ প্রথমে বললেন, ‘আমরা নির্বাচনে যাব। তারপর বললেন, বিএনপি না গেলে সেই নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অতএব, আমরা নির্বাচনে যাব না। আমরা নির্বাচনে নেই।’ সেই না যাওয়া নির্বাচন থেকে কীভাবে তাঁর দল ৪০টি আসন পেল, আমজনতা বুঝতে অক্ষম। এত দিন জানতাম নির্বাচনে অংশ নিলে জয়-পরাজয় আছে। কিন্তু একজন সামরিক কাম রাজনৈতিক নেতা দেখিয়ে দিলেন, নির্বাচন না করেও নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়। সব সম্ভবের বাংলাদেশে সবই সম্ভব।
নির্বাচনের আগে এরশাদ দলের একাংশকে বললেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করো। আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি না। আরেক পক্ষকে বলা হলো, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার কোরো না। এই দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে তিনি যেমন শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলেছিলেন, তেমনি খালেদা জিয়াকেও এই বার্তা দিলেন যে নির্বাচন না হলে আমরা আপনার সঙ্গেই আছি। খালেদা জিয়া যদি সত্যি সত্যি নির্বাচনটি ঠেকাতে পারতেন, তাহলে এরশাদ হয়তো এখন তাঁরই বিশেষ দূত হতেন।
জাতীয় পার্টির এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলে হলো সুবিধাবাদ। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত মুফতে সুবিধা। দলের যাঁরা সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা একরকম। আর যাঁরা সুবিধা পাননি, এরশাদের কথায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা আরেক রকম হওয়াই স্বাভাবিক। এরশাদ জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু নিজে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত থাকবেন, এটি কেমন নৈতিকতা? এই প্রশ্নটি করেই মসিউর রহমান (রাঙ্গা) ও তাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর রোষের মুখে পড়েছেন।
এখন এরশাদকে ছাড়লেও তাঁরা পদ ছাড়বেন না। ফাউ খাওয়ার ও মুফতে পাওয়ার রাজনীতির পরিণাম এমনই হয়। জাতীয় পার্টিতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কেবল তিনজন নন, আরও অনেক বেশি। সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পান। কাজী ফিরোজ রশীদ উপনেতা হলে তিনিও পাবেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রওশনের অবস্থান কেবিনেট মন্ত্রীর সমান। আর এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
২.
রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব তথা আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতার সংকট কেবল সাবেক স্বৈরাচারের দলে থাকলে আশ্বস্ত হওয়া যেত। জোর গলায় বলতে পারতাম, আসুন, আমরা স্বৈরাচার ও একাত্তরের রাজাকারকে বাদ দিয়েই একটি সাচ্চা ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলি। কেননা, আমাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের সংগ্রামের দুই লড়াকু নেত্রী আছেন, যাঁরা এক হয়ে স্বৈরাচারকে হটিয়েছিলেন। কিন্তু বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির করুণ ও নাজুক সাংগঠনিক অবস্থা দেখে আপসোস হয়। এত বড় দল, এত বড় নেত্রী। কিন্তু দলের অবস্থা এত করুণ ও বেহাল কেন?
অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন যে বিএনপি সাড়ে সাত বছর ক্ষমতার বাইরে এবং নেতা-কর্মীরা জেল-জুলুমের শিকার। এ কারণে দলের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, সরকারের দমনপীড়নে কোনো দল দুর্বল হয় না। দুর্বল হয় ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁদের নানা অপকর্মের কারণে। ২০০১-০৬ সালে ক্ষমতাসীনেরা যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, তা মানুষের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। প্রতিবছর ২১ আগস্ট, ১৭ আগস্ট, ২৭ জানুয়ারি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বিএনপি নেতা-নেত্রীরা সেসব থেকে শিক্ষা নিয়েছেন বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ভুল স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে বলেন, তারা যা করেছেন, ঠিকই করেছেন।
গত পাঁচ বছরে বিএনপির নেতারা জনগণের সমস্যা-সংকট নিয়ে কোনো আন্দোলন করেননি। তাঁদের একমাত্র দাবি বা এজেন্ডা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কী করবেন, তা বলেন না। ইদানীং লন্ডনপ্রবাসী নেতা তারেক রহমানের বাণী ও বাচনভঙ্গিতে বোঝা যায়, আরেকবার ক্ষমতায় আসতে পারলে আওয়ামী লীগকে দেখিয়ে দেবে। এখন যেমন আওয়ামী লীগ দেখাচ্ছে। আসলে এখন শিক্ষা নেওয়ার রাজনীতিকে দূরে ঠেলে শিক্ষা দেওয়ার রাজনীতিরই মহড়া চলছে। বিএনপির কার্যক্রম এখন প্রেসক্লাব ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সীমিত হয়ে পড়েছে। আর দলের নীতি–কৌশল থেকে শুরু করে মহানগর কিংবা ছাত্রদলের কমিটিও ঠিক হয় লন্ডনে।
৩.
দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ কীভাবে চলছে, তা কেন্দ্রীয় নেতারাও জানেন না। জিজ্ঞেস করলে বলেন, সব জানেন সভানেত্রী। সব যদি সভানেত্রীই জানবেন, আপনারা কী করছেন? দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখতে কিছুদিন পরপর গণভবনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়, সাংগঠনিক শক্তি সুসংহত করার সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু কার্যকর হয় না। ঢাকা মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে। সেখানে যাঁরা নেতা, তাঁরাই মন্ত্রী। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের অবস্থা এতটাই নাজুক যে গত জুনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আহূত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়। প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল: কোনো কর্মী আসেননি, মলিন মুখে চলে গেলেন নেতারাও। এখানে রিপোর্টের কিছু অংশ তুলে ধরছি: ‘৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানও ছিল কর্মীশূন্য৷ গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচিতেও ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷ এতে সাতজন নেতা উপস্থিত হলেও কোনো কর্মী না থাকায় বক্তৃতা না করেই তাঁরা চলে যান৷ আগের দিন একই স্থানে একই রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ তাতে অল্প কজন কর্মী উপস্থিত ছিলেন৷ গতকাল তাও ছিল না৷’
আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেন, বিএনপি জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে কাজ করছে। জামায়াতে ইসলামীর ভাগ্য আদালতে ঝুলছে। ১৪ দলীয় জোটের নেতারা সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন। বৃহস্পতিবার ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের সাংসদেরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সংবিধান সংশোধনে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বিরোধী দলের বিগত আন্দোলনে বিদেশি জঙ্গিদের অংশগ্রহণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ রকম একটি লুফে নেওয়া তথ্য বাম নেতারা পেলেন, অথচ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের কেউ জানলেন না! একই সঙ্গে যদি তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের যুব ও ছাত্রসংগঠনটির নানা অপকর্মের চিত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতেন, দেশবাসী কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারত। যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতারা প্রকাশ্যে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন, তখন দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নিরর্থক বৈকি।
আসলে রাজনীতির নামে এখন চলছে নীতি ও আদর্শ বিসর্জনের মহড়া। এরশাদ তার জ্বলন্ত প্রতীক হলেও ধীরে ধীরে সব দলেই মহামারির মতো সংক্রমিত হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের কাছে সাংগঠনিক কর্মসূচির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভ। আর এ জন্য সাংসদ সাংসদের বিরুদ্ধে, মন্ত্রী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে, নেতা দলের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করছেন না।
রাজনীতির এই নষ্টামি, ভ্রষ্টামি দেখে দেখে দেশের মানুষ ত্যক্ত, বিরক্ত। অপরাজনীতির এই কালব্যাধি থেকে মুক্তি না পেলে হয়তো একদিন তারাও স্লোগান তুলবে ‘আসুন, আমরা সবাই এরশাদ হই!’
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.