অবশেষে জামায়াতের মধ্যস্থতায় সমঝোতার চেষ্টা পাকিস্তানে

পাকিস্তানে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের মধ্যস্থতায় এখন জামায়াতে ইসলামী। এ দলের প্রধান সিরাজুল হক মধ্যস্থতার ভূমিকায়। মঙ্গলবার ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি তার মধ্যস্থতা মেনে নেন। ফলে সিরাজুল হক এখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার একটি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইমরান খান, তাহিরুল কাদরির সঙ্গে এর আগে সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের বৈঠক ব্যর্থ হয়। তারা প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এর পরই সেনাপ্রধান সাক্ষাৎ করেন নওয়াজের সঙ্গে। তাকে পদত্যাগের অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। আহ্বান করা হয় পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন। মঙ্গলবার সেই পার্লামেন্ট প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে। সব বিরোধী দল তার পক্ষে অবস্থান নেয়। ওদিকে, পার্লামেন্ট ঘিরে রাখা ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) ও পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি)’র সমর্থকের সংখ্যা কমতে থাকে। তারা দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় খোলা রাজপথে অবস্থান নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকে হয়ে পড়েন ধৈর্যহারা। ফলে গতকাল তাদের সংখ্যা হাজার হাজার থেকে কমে কয়েক শ’তে পৌঁছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি পার্লামেন্টের আস্থা, অন্যদিকে সমর্থক কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি মঙ্গলবার সমঝোতা সংলাপে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ইমরান খান তার সমর্থকদের বলেন, সিরাজুল হক আলোচনা নিয়ে আসছেন। আমরা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করবো। তাদের সামনে আমাদের অবস্থান তুলে ধরবো। তারাও বলবেন। সব সময়ই আলোচনার দরজা খোলা। এরই প্রেক্ষিতে গতকাল সমঝোতার পথ খুলে যায়। টান টান উত্তেজনার মধ্যে জনমনে আপাতত ফিরেছে স্বস্তি। কারণ, প্রধানমন্ত্রীকে সেনাপ্রধান পদত্যাগের অনুরোধ জানানোর পর বিশ্লেষকরা ধারণা করছিলেন, নওয়াজ শরিফের সামনে দিনক্ষণ গণনার পালা। যে কোন সময় সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে। রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সেনাবাহিনীর আগ্রহ দেখে তাদের প্রতি সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তবে সেনাপ্রধানের সামনে নওয়াজ শরিফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি পদত্যাগ করবেন না। এমনকি ছুটিতে বিদেশেও যাবেন না। এরপরই হয় পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশন। সেখানে সব দল যখন নওয়াজের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনে, তখন অনেকেই মনে করেন পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্র লালন করতে পেরেছেন। এর ফলে সেনাবাহিনী দৃশ্যত চুপচাপ রয়েছে। নওয়াজের পদত্যাগ- এই এক দফা এক দাবি নিয়ে আন্দোলনরত ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি নমনীয় হন। শুরু হয় আলোচনা। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান সিরাজুল হক বলেন, দেশে যে সঙ্কট চলছে তাতে পুরো জাতি বিরক্ত। ইমরান খানের দল খোলা মনে আমাদের আলোচনার অনুরোধ রেখেছে। এ জন্য তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আলোচনার জন্য বিরোধী রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি কমিটি করার কথা। সেই কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসছেন ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি। তবে পাকিস্তানের রাজনীতি যে কোন মুহূর্তে পাল্টে যায়। এই আলোচনায়ই যে সমাধান বেরিয়ে আসবে তেমনটি জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছে না। রাজধানী ইসলামাবাদে সহিংস ঘটনা কমে গেছে। দৃশ্যত এখন শান্ত সব। তা সত্ত্বেও সেখানে নীরবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন অনেকে। বিশেষ করে ইমরান খানের পিটিআই-এর সভাপতি জাভেদ হাশমি দলের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানে বাংলাদেশ মডেল কাজ করতে চলেছে। ইমরান খান কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে যেমন নেপথ্যে সেনাবাহিনী থেকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল পাকিস্তানেও তেমনটি হতে চলেছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সামরিক অভ্যুত্থানপ্রবণ দেশ। ১৯৪৭ সালে বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সেখানে হয়ে গেছে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৯৯ সালে। তখনও ক্ষমতায় ছিলেন নওয়াজ শরিফ। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। এবার নির্বাচিত হয়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন নওয়াজ শরিফ। এতে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। এ জন্যই পাকিস্তান সঙ্কটের পর এবার নতুন করে অভ্যুত্থান আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিছু বিশ্লেষক তাই মনে করেন, নওয়াজ শরিফ পার্লামেন্টের সমর্থন পেয়ে টিকে গেলেও সেনাবাহিনী তার ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য থেকে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। নওয়াজ শরিফ আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র ইস্যুতে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলা শুরু করতে পারে তারা। ওদিকে টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক সিনিয়র এডিটর ইশান ঠারুর লিখেছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ফ্যাসাদ আরও গভীর হয়েছে। তবে নওয়াজ শরিফ পাঞ্জাবে ব্যাপক জনপ্রিয়। অনেকে বিশ্বাস করেন, তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাবেন। দেশের অর্থনীতিতে পুনর্জীবন দেবেন। কিন্তু তার সরকারের পারফরমেন্সের সমালোচনা শুরু হয়ে যায় শুরু থেকেই। কারণ, পাকিস্তানে এখনও রয়েছে বিদ্যুতের ভয়াবহ সঙ্কট। এছাড়া আরও সমস্যা তো রয়েছেই। এরই মধ্যে তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বিচার করছেন। ১৯৯৯ সালে নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন তিনি। সেই পারভেজ মোশাররফের বিচারের ঘটনায় দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা ক্ষিপ্ত হয়ে থাকতে পারেন। নওয়াজ শরিফ গত বছর ক্ষমতায় এসেছেন তৃতীয় বারের মতো। পাকিস্তানের ইতিহাসে সেটাই প্রথম বেসামরিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর।

পরামর্শ চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট
পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে পরামর্শ চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাদেরকে বলা হয়েছে, পিটিআই ও পিএটির যে অবস্থান ধর্মঘট চলছে, সংবিধান বহির্ভূত যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে তার প্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় তা দলীয় নেতাদের কাছে লিখিতভাবে আহ্বান করা হয়েছে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট সব পার্লামেন্টারি দলের কাছে একটি সমন পাঠায়। তাতে সব দলকে আদালতে সমন করা হয়, যাতে সমস্যার সমাধান করা যায়। গতকাল এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি নাসিরুল মুলকের সভাপতিত্বে ৫ বিচারকের বেঞ্চে শুনানি হয়।
ওয়েব সাইট হ্যাকড
পাকিস্তান সরকার, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে অ্যানোনিমাস নামের হ্যাকার গোষ্ঠী। এ সময় তারা স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করে দেয়। মঙ্গলবার এই হ্যাকিং শুরু হলেও গতকালও তা অব্যাহত থাকে। প্রথমে তারা হ্যাকিং শুরু করলে সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইট স্থবির হয়ে পড়ে। তারা প্রকাশ করে দেয় একটি ‘জিপ ফাইল’। এতে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৩ হাজার ব্যাংক রেকর্ড রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.