বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী নিয়ে এনসিটিবি’র ছেলেখেলা by নুর মোহাম্মদ

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ৮ নং পৃষ্ঠায় ১১ নম্বর লাইনে বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম ‘সায়েরা খাতুন’ লেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লেখা এই বইটির তত্ত্বাবধান ও সম্পাদনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রয়াত এমপি বেবী মওদুদ। অথচ জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক মুদ্রিত চলতি বছর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবই ‘সাহিত্য পাঠ’ বইয়ের লেখক পরিচিতিতে তা বিকৃত করে লেখা হয়েছে ‘সায়ারা খাতুন’। একই ভাবে অষ্টম শ্রেণীর ‘সাহিত্য কণিকা’ বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ গদ্যের ৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখক পরিচিতির তিন নম্বর লাইনে মাতার নাম ‘সাহেরা খাতুন’ লেখা হয়েছে। একাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ শীর্ষক অধ্যায়টি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে বলে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম তিন জায়গায় তিন ভাবে লেখা হয়েছে। আর এই বিতর্কিত কাজটি করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)।
এখানেই শেষ নয়, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রীর নামের বানান যেভাবে রয়েছে, এনসিটিবি সে ক্ষেত্রেও বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনাকে ছোট বেলায় ‘হাচু’ নামে ডাকতেন। এই বিষয়টি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের বিভিন্ন জায়গায়ও উল্লেখের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা নথিতেও রয়েছে। অথচ এনসিটিবি’র একাদশ শ্রেণীর বইয়ে ‘হাসু’ লেখা হয়েছে। একই পৃষ্ঠায় লেখা আছে একটি প্যারায় দেশ ভাগের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ হিসেবে লেখা আছে- ‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। গোপালগঞ্জ মহকুমার যে কেউ আসে, তাদের এক প্রশ্ন ‘আপনাকে কেন জেলে নেয়? আপনিই তো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছেন।’ আবার বলে ‘কত কথা বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে, অত্যাচার-জুলুম থাকবে না। কয়েক বছর হয়ে গেল দুঃখই তো আরও বাড়ছে, কমার লক্ষণ তো দেখছি না। চাউলের দাম কত বেড়ে গেছে।’ কি উত্তর দেবো! এরা সাধারণ মানুষ। কি করে এদের বোঝাবো! গ্রামের অনেক মাতবর শ্রেণীর লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা সুন্দরভাবে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানোও যাবে না। পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই বেশি দেখছে। পাকিস্তান কি করে গড়তে হবে, জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবে সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নাই।’ ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পর গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করলো যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়।’
এইচএসসি ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনায় ‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন...’ বাক্য থেকে শুধু ‘মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম’ রেখে আগের অংশটুকু বাদ দেয়া হয়েছে। এরপরের ১২টি বাক্য বাদ দেয়া হয়েছে। এরপর ‘১৯৫১ সালে ঢাকায় গুলি...’ এই অংশ থেকে শুরু করা হয়েছে। এভাবে ইচ্ছামতো কাটছাঁট করে প্রকাশ করা ওই লেখার শেষে লিখে দেয়া হয়েছে সংক্ষেপিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লেখকরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাঝখান থেকে এই লাইনগুলো বাদ দিয়েছেন। কাউকে খুশি করতে শিক্ষার্থীদের বিপাকে ফেলেছেন। সৃজনশীল পদ্ধতি হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক সময় রেফারেন্স বই পড়তে হয়। কিন্তু একটি জায়গায় মাঝখান থেকে এভাবে বাদ দেয়ার পাশাপাশি নামের বানানে ভুল করায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিভিন্ন কলেজ থেকে মানবজমিন অফিসে টেলিফোন করছেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যেভাবে মাঝখান থেকে বারটি বাক্য বাদ দেয়া হয়েছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটাকেই বলে ইতিহাসবিকৃতি। কোন বইকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করলে যে কেউ তার মতো করে লাইন বা অনুচ্ছেদ বাদ দিতে পারেন না। যে শিক্ষকরা এ কাজটি করেছে তারা কাউকে খুশি করতে তা করেছে। যা একেবারেই উচিত হয়নি।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বইয়ের ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বইটি আমি ও বেবী মওদুদ বঙ্গবন্ধুর মূল খাতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে সম্পাদনা ও সংশোধনের কাজটি প্রথমে শেষ করি। তারপর অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আমি ও বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, প্রুফ দেখা, টীকা দেখা, স্ক্যান, ছবি নির্বাচন ইত্যাদি যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ করি। শেখ রেহেনা আমাদের এসব কাজের অংশ হিসেবে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেছে।’ এই বইয়ের সম্পাদনা প্রধানমন্ত্রী করার পরও কেন মাঝখান থেকে কিছু লাইন বাদ দেয়া হলো, এর উদ্দেশ্য কি হতে পারে- জানতে চাইলে এমাজউদ্দিন বলেন, এটি কাউকে খুশি করতে করা হয়েছে।
অন্যদিকে এই নোট ও গাইড বইয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্ম তারিখ, মায়ের নাম, প্রধানমন্ত্রীর ডাক নাম একেক প্রকাশনী একেক ভাবে লিখেছে। পাঞ্জেরি প্রকাশনী বাংলা সহপাঠ বইয়ের ১৯৯ পৃষ্ঠায় ৬৪ নং প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু জন্মতারিখ কবে? চারটি অপশন দেয়া হলেও কোথায় সঠিক জন্ম তারিখ ১৭ই মার্চ উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে ২০শে মার্চ তার জন্মতারিখ লেখা হয়েছে। জুপিটার পাবলিকেশন্স বাংলা গাইড বইয়ে ২৩৩ পৃষ্ঠায় ‘আগরতলা যড়যন্ত্র’ মামলায় বলা হয়েছে। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই মামলাকে ‘ষড়যন্ত্র’ নয় বাদ দিয়ে একে ‘ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা’ বলার কথা।
এদিকে এনসিটিবি’র পাঠ্যবইয়ে এভাবে বিভ্রান্তি থাকায় বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়ক বই রচনার ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। এ অবস্থায় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সরাসরি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইকে রেফারেন্স করে গাইড বই লিখেছে। তাদের প্রকাশিত বইয়ের ২৬৫ পৃষ্ঠায় ‘বায়ান্নর দিনগুলো’র সৃজনশীল প্রশ্ন রচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছে ‘শেখ মুজিবুর রহমান শোষণমুক্ত স্বপ্নের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন’। এ ধরনের বিষয় এনসিটিবি’র দৃষ্টিতে পড়ার পর তারা বিষয়টিকে ‘ইতিহাসবিকৃতি’ বলতে চাইছে। এ নিয়ে তারা একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। দু’একদিনের মধ্যে ওই তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে এনসিটিবি। যদিও পাঠ্যবইয়ে এই অংশটুকু নেই।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি সচিব বজ্রগোপাল ভৌমিক জানান, বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আগামী সংস্করণে সব শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম অসমাপ্ত আত্মজীবনীর যেটা লেখা হয়েছে সেই নাম উল্লেখ করা হবে। তিনি বলেন, এই অধ্যায়টি বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী বইকে রেফারেন্স করা হয়েছে। সেখানে যে নাম লেখা হয়েছে সেটাই সঠিক। মাঝখান থেকে কয়েকটি লাইন বাদ দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি করা যায় কিন্তু এখানে যেভাবে করা হয়েছে তাতে বাক্যটি অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা দেখবো। একাদশ শ্রেণীর সাহিত্য পাঠ বইয়ের সম্পাদক ড. মাহবুবুল হক জানান, এই শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের জন্য যতটুকু তথ্য প্রয়োজন ততটুকুই দেয়া হয়েছে। যে টুকু বিষয় নিয়ে বিতর্ক হতে পারে সেটুকু বাদ দেয়া হয়েছে। লেখক কমিটি যতটুকু সমর্থন করেছে আমি সেটুকু সমর্থন করেছি। এনসিটিবি ইচ্ছা করলে সংযোজন-বিয়োজন করতে পারে। তিনি বলেন, এটা তো গল্প না, গল্প থেকেও যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দেয়া যায়। এটা নিয়ে বিতর্ক করার কিছু নেই। শিক্ষার্থীদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দেয়া হয়েছে।
বইটির লেখক ও সংকলনের সম্পাদনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক, তার সঙ্গে দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক, ড. সরকার আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ভাষাবিজ্ঞান শিক্ষক ড. সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান ও প্রীতিকুমার সরকার।

No comments

Powered by Blogger.