এভাবে চললে ইসরায়েল বিপদে পড়বে by ইউরি আভনেরি

হ্যাঁ, পরবর্তী যুদ্ধের জন্য আপনি ছক কষছেন। এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন—যতক্ষণ না সবকিছু নিখুঁত হয়।
আর যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন, যুদ্ধে আরেকটি পক্ষ আছে। তাদেরও একটি পরিকল্পনা আছে, তারাও এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে। 
দুই পরিকল্পনা মিলে গেলে সবকিছুই ভুল প্রতিপন্ন হয়। উভয় পরিকল্পনাই ভেঙে পড়ে। কেউই জানে না, কী হতে যাচ্ছে। কীভাবে তা হবে। সে সময় পরিকল্পনা করেননি, সে রকম কাজ করতে হয়। সেটা যদি আবার বেশি বেশি হয়ে যায়, তখন এর থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরু করার চেয়ে শেষ করা কঠিন। বিশেষ করে, যখন দুই পক্ষেরই বিজয় ঘোষণা করার তাড়া থাকে। আমরা আসলে ঠিক সে রকম একটি পর্যায়ে আছি। এটা কীভাবে শুরু হলো। কোথা থেকে আপনি শুরু করতে চান, তার ওপর সেটা নির্ভর করে।
গাজায় যা ঘটেছে, তা অন্য কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ঘটেছে। অন্য পক্ষ কিছু করেছে বিধায় আপনি কিছু করেন। ইতিহাসের শুরু থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। বা অন্তত স্যামসনের নায়ক হয়ে ওঠার পর থেকে এ রকম নজির ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে।
স্মৃতি হাতড়ে দেখা যায়, ফিলিস্তিনিরা স্যামসনকে ধরে চোখ বেঁধে গাজায় নিয়ে আসে। সেখানে তিনি দর্শক ও নেতাদের ওপর মন্দির ভেঙে ফেলেন, নিজে আত্মহত্যা করার পাশাপাশি সবাইকে তিনি হত্যা করেন। চিৎকার করে স্যামসন বলেন, ‘আমার আত্মা যেন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মারা পড়ে!’

স্যামসনের নজির বেশি পুরোনো মনে হলে ১৯৬৭ সালের বর্তমান দখলদারির শুরুতে যাওয়া যাক। এক বন্ধু আমার এক নিবন্ধের কথা মনে করিয়ে দেন। এটি আমি লিখেছিলাম, ছয় দিনের যুদ্ধে পুনরায় গাজা দখলের দুই বছরেরও কম সময় পরে। সে সময় আমি দুজন নির্মাণশ্রমিককে দেখেছিলাম, একজন পশ্চিম তীরের, আরেকজন গাজার। তাঁরা একই কাজ করলেও গাজার শ্রমিক পশ্চিম তীরের শ্রমিকের চেয়ে কম মজুরি পান।
নেসেটেরএকজন সদস্য হিসেবে আমি বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখলাম। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, এটা নীতিগত ব্যাপার। এর লক্ষ্য হচ্ছে, আরবদের গাজা থেকে তাড়িয়ে পশ্চিম তীরে বসতি করতে বাধ্য করা। নিশ্চিতভাবেই তারা এ লক্ষ্যে খুব একটা সফল হতে পারেনি। যদিও চার লাখ থেকে গাজার জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখে।
তারপর ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি সতর্ক করে বলেছিলাম, এভাবে চলতে থাকলে আমরা মহাবিপদের মুখোমুখি হব। এর ফলে সেখানে মারাত্মক আকারে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়তে পারে, অথবা আমাদের চরম নিবর্তনমূলক নীতি নিতে হবে, সেটা হলে সারা দুনিয়াই আমাদের দুয়োধ্বনি দেবে। নিজের ঢোল বাজানোর জন্য কথাটা বলছি না, যেকোনো একজন যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই এই নিপীড়নের ফল কী হবে, তা বুঝতে পারেন, সেটা বলার জন্যই এ কথা বললাম।
এ জায়গায় যেতে গাজার অনেক সময় লেগেছে। নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগের কথা মনে পড়ছে, একটি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে সেবার গাজায় গিয়েছিলাম। গাজা তখন চমৎকার একটি জায়গা। শেষ বিকেলে কেন্দ্রীয় অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটছিলাম। মানুষের সঙ্গে অনেক কথা হয়, আমরা যে ইসরায়েলি, সেটা বুঝতে পেরে‌ও তারা আমাদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে। গাজার অধিকাংশ স্থান থেকে যেদিন ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হলো, সেদিনটির কথাও আমার মনে পড়ে। গাজা শহরের কাছে ইসরায়েলের একটি সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে। এটি এত উঁচু ছিল যে সেখান থেকে গাজার প্রতিটি ঘরের জানালা গলে ঘরের ভেতরটা দেখা যেত। সেনারা চলে গেলে আমি সবচেয়ে ওপরের তলায় উঠে যাই, সেখান থেকে ছেলেছোকরাদের চলাফেরা দেখে বাইবেলে বর্ণিত জ্যাকবের স্বপ্নে ফেরেশতাদের মইয়ে ওঠার গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। তার পরও আমরা সুখী। সেই ছেলেরা বোধ হয় এখন হামাসের সদস্য।

সে সময় গাজার ভূমিপুত্র ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনে ফিরে এসে গাজায় তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। একটি চমৎকার বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছিল। নতুন একটি সমুদ্রবন্দর স্থাপনের খবরও চাউর হয়ে গিয়েছিল। এই বন্দর স্থাপন হলে গাজাবাসীর জীবনমান উন্নত হতো, ফলে ইসলামি চরমপন্থী দলকে ভোট দেওয়ার প্রবণতাও কমে আসত। কিন্তু ইসরায়েলের কারণে এ বন্দর আর আলোর মুখ দেখেনি। অসলো চুক্তির বিপক্ষে গিয়ে ইসরায়েল গাজার সঙ্গে পশ্চিম তীরের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নব সম্ভাবনা রুদ্ধ করতেই ইসরায়েল এ কাজ করেছিল।
কিন্তু শ্যারন এই উপত্যকাটি ফিলিস্তিনের হাতে তুলে দেননি। ফলে সেনা প্রত্যাহার হওয়ার পরও সেখানে কোনো সরকার ছিল না, দুই পক্ষের মধ্যে কোনো ঐকমত্য ছিল না; চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছিল সেখানে। এরপর ২০০৬ সালে জিমি কার্টারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হলে গাজার মতো পশ্চিম তীরের মানুষও হামাসকে নির্বাচিত করে। কিন্তু তাদের ক্ষমতায় যেতে দেওয়া না হলে সংগঠনটি জোরপূর্বক গাজা উপত্যকা দখল করে নেয়। জনগণও একে স্বাগত জানায়।
এর জবাবে ইসরায়েল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শুধু কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক পণ্য সেখানে ঢুকতে দিয়েছে ইসরায়েল। এমনকি পাস্তাকেও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে গাজায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গাজার দক্ষিণে মিসর, উত্তর ও পূর্বে ইসরায়েল, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। ফলে গাজা এখন ‘দুনিয়ার সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে পারবে না, আমাদের আধা ফ্যাসিস্ট শাসকেরা যতই আস্ফালন করুন না কেন। তাঁরা আসলে সেটা চানও না। হামাস পরাজিত হলে গাজাকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে। তার মানে, গাজা ও পশ্চিম তীরের মিলন ঘটবে। ফলে ইসরায়েলের এত কিছু সব ভেস্তে যাবে।
হামাস থাকলেও ইসরায়েল এই ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’কে বাড়তে দিতে চাইবে না। নিষেধাজ্ঞায় শিথিলতা এলেও তা আসবে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। হামাসের ওপর গাজার জনগণের আস্থা আরও বাড়বে। ইসরায়েলের এসব নারকীয়তার বদলা নেওয়ার জন্য তারা ফুঁসে উঠবে। তেমনটা হলে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, সব ইসরায়েলিই এটা মনে করে।
এ সমস্যা নিরসনে দুই রাষ্ট্রের তত্ত্বের ভিত্তিতে শান্তি আলোচনা শুরু করতে হবে, এটার শেষও হতে হবে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে। এ আলোচনা থেকে যে ঐকমত্য হবে, হামাসের উচিত সেটা মেনে নেওয়া। ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টি ঠিকঠাক গুরুত্ব দিতে হবে। গাজার বন্দর খুলে দিতে হবে, যাতে পুরো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রই পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে পারে।
এসব সমস্যা আলাদাভাবে সমাধান করা যাবে না, এগুলোর একত্র সমাধান হতে হবে। এ প্রক্রিয়া শুরু না হলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা এক অশেষ যুদ্ধের বাহুডোরে বাঁধা পড়ব।

কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক।

No comments

Powered by Blogger.