গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতেই সম্প্রচার নীতিমালা -সুজনের গোলটেবিল বৈঠক

গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার সম্প্রচার নীতিমালা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সুজন আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনার বক্তারা। তারা বলেছেন, সরকার ঘোষিত এই নীতিমালা ইতিমধ্যে দেশের সচেতন মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই এটি বাতিল করা উচিত। বক্তারা নীতিমালা করতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনেরও একটি বিকল্প পরামর্শ দেন।

গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সমপ্রচার নীতিমালা, আইন ও সমপ্রচার কমিশন’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন-এর জাতীয় কমিটির সদস্য মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। এতে বলা হয়, সরকার ঘোষিত সম্প্রচার নীতিমালা ইতিমধ্যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। নীতিমালার রচয়িতারা ছাড়া আর কেউ এই নীতিমালার সমর্থনে এগিয়ে যায়নি। এমনকি সাংবাদিকদের যে আওয়ামী গ্রুপ রয়েছে তারাও এর সমালোচনায় মুখর। সরকার আশা করেছিল এই নীতিমালা দিয়ে স্বাধীন সম্প্রচার মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু প্রথম স্তরেই বাধাগ্রস্ত হবে। এই নীতিমালার পেছনে সরকারের নীল নকশা রয়েছে দাবি করে বলা হয়, ৫ই জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর সরকার অনেকটা অস্বস্তিতে আছে। প্রায় বিনা নির্বাচনের জাতীয় সংসদ নিয়েও সরকার অস্বস্তিতে। দেশে তো বটেই, বিদেশেও অনেক বন্ধু রাষ্ট্র প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। সরকার নানা রাজনৈতিক কৌশলে বিরোধী মতকে কোণঠাসা ও কাবু করে ফেলেছে। জাতীয় পার্টিকেও ভোঁতা করে দিয়েছে। বাস্তব অর্থে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই সরকারের কার্যকর বিরোধিতা করার মতো এখন আর পরিবেশ নেই। সরকারের যাবতীয় কুকীর্তি নিয়ে সমালোচনায় মুখর এখন গণমাধ্যম। সরকার গণমাধ্যমকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আর কয়েকটি নাগরিক ফোরামও সরকারের বশংবদ হতে রাজি হয়নি। এরাই এখন সরকারের তথাকথিত ‘স্বপ্ন’ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিভির ‘সংবাদ’ ও সমালোচকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই প্রথম পদক্ষেপ: জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা। এটা সফল হলে আরও কিছু পদক্ষেপ হয়তো সরকার নেবে। এভাবে বর্তমান সরকার অনেকটা ‘বাকশাল’ স্টাইলে ‘এক নেতা এক দেশ’ ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। প্রবন্ধে সম্প্রচার কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির বিকল্প একটি প্রস্তাব রাখা হয়। প্রস্তাব অনুসারে, সরকার প্রধান অংশীজন (এ্যাটকো), জাতীয়ভিত্তিক বিভিন্ন পেশাজীবী ফোরাম (অন্তত ১০টি), সক্রিয় নাগরিক ফোরাম (অন্তত ৫টি)-এদেরকে ১ জন চেয়ারম্যান ও ১০ জন সদস্যের নাম প্রস্তাব করার দায়িত্ব দিতে পারেন। সদস্যদের যোগ্যতার মাপকাঠিও বলে দিতে হবে। যাদের নাম প্রত্যেক তালিকায় কমন হবে তাদেরকেই সরকার সমপ্রচার কমিশনে মনোনয়ন দিতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় তথ্য মন্ত্রণালয় জানতে পারবেন কমন নামগুলোর প্রতি বহু লোকের আস্থা রয়েছে। সার্চ কমিটিতে শুধু সদস্যদের মতামত পাওয়া যায়। আর এই পদ্ধতিতে অন্তত ২০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির পরোক্ষ মতামত পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোরাম তাদের নির্বাহী কমিটির সভা করে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে নামগুলো প্রস্তাব করবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সমপ্রতি বিচারপতিদের অভিশংসনের আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে। এর ফলে তাদের নৈতিকতা খর্ব করা হয়েছে। এখন যদি কণ্ঠরোধের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় তাহলে কয়েকদিন সবাই মানববন্ধন বা আন্দোলন করবে। এরপর থেমে যাবে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পরই সরকার এই সমপ্রচার নীতিমালা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, সরকার মনে করে যাদের চুল-দাড়ি পেকেছে তারাই ভাল পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু তা ঠিক নয়, বাস্তববাদী তরুণদের মধ্যে অনেক মেধা রয়েছে। তারা মাঠে ঘাটে কাজ করে। তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। তিনি বলেন, এই নীতিমালা যদি করতে হয় তাহলে মিডিয়ার মালিক, চিফ রিপোর্টার, মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টার, নাগরিক সমাজ সবার সঙ্গে আলাপ করেই করা হোক। তা না হলে এটা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। দেশ ক্রমেই নিয়ন্ত্রণবাদী শাসনের দিকে ধাবিত হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এছাড়া যে কমিশন করা হবে  সেটা যে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে তার নিশ্চয়তা কি? কারণ সেখানে যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তাদের তো নিয়োগকর্তারই দাসত্ব করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে র‌্যাব এরশাদকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এটা ছিল সরকারের একটা কৌশল। কিছু কিছু দল ও লোককে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্যই এসব পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
সরকারের কোন কাজে দ্বিমত পোষণ করার মতো দেশে এখন কোন কোন লোক নেই উল্লেখ করে দিলারা চৌধুরী বলেন, সংসদে কার্যত বিরোধী দল না থাকায় সেখানেও জনকল্যাণে কথা বলা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ দু’একটা ঘটনা গণমাধ্যমের সুবাদেই পেয়ে থাকে। আর এখন এই সুযোগ থেকেও জনগণকে বিচ্ছিন্ন করতেই এই নীতিমালা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন জনগণের পক্ষে টকশোতে কথা বলা হয়, সংসদে বলা হতো আর গণমাধ্যমকর্মীরা প্রকাশ করতো। তাই সরকার টকশো নিয়ন্ত্রণের পর এবার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এরফলে দেশে অপশাসন শুরু হবে। মূলত ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতেই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সাবেক তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা অনুসরণ করলে বাস্তব অনেক কিছুই গণ্যমাধ্যমে তুলে ধরা যাবে না। যেমন আমাদের নেতানেত্রীরা দেশের বাইরে টাকা পাচার করলে সে সম্পর্কে বক্তব্য প্রচার করা সম্ভব হবে না। কারণ সে সব ঘটনার তদন্ত করে কারও পক্ষে বলা সম্ভব হবে না। বর্তমানে আমাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার নামে যেটা হয়েছে সেটা কোন নীতিমালাই হয়নি। প্রতিপক্ষের মতামত ও দর্শন যেন প্রকাশ না পায় তার ইতি টানা হয়েছে।
আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার খসড়া ওয়েবসাইটে থাকা অবস্থায় আমরা মতামত দেইনি। সেখানে পরামর্শ দিলে আজকে সমালোচনা অন্যভাবে হতো। সম্প্রচার নীতিমালার বেশির ভাগ অংশ নির্দোষ। তবে অনেক জায়গা বিপজ্জনক। নীতিমালায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, আমরা দেশীয় চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতার দায় দিচ্ছি। অন্যদিকে বিদেশী চলচ্চিত্র উপভোগের মাধ্যমে তাদের পূর্ণতা দান করছি। নীতিমালায় শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়ে যেভাবে জোর দেয়া হয়েছে তাতে করে আমাদের অনেকের বক্তব্য সম্প্রচারযোগ্য নয়। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর মধ্যে সুষম ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা সৃষ্টির কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, নীতিমালার কিছু মৌলিক বিষয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একমত হওয়া যাচ্ছে না। যেসব বিষয় প্রয়োগ সম্ভব নয় সেগুলো বহাল রাখার বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিদেশী সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে নীতিমালায় কোন কিছুর উল্লেখ নেই। নীতিমালার চেয়ে জরুরি হচ্ছে সাংবাদিকদের পেশার উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া। এজন্য গণমাধ্যমেরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গত সাড়ে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সরকারের কাছে আশাবাদী হতে পারি না। আমরা যদি বিগত সময়ে গঠিত কমিশনগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখা যাবে কোনটাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। তথ্য কমিশন সম্পর্কে আমাদের অত্যন্ত করুণ অভিজ্ঞতা। সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সভাপতি হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, এই মুহূর্তে নীতিমালার কোন দরকার ছিল না। নতুন নীতিমালা করার জন্য কমিশন আগে গঠন করা দরকার। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা ও মিরপুরে ঝুট ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিডিয়ার কারণে ধরা পড়েছে। যে কারণে সরকার এখন গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সম্প্রচার নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য নীতিমালা হয়নি। নতুন করে নীতিমালা করতে হবে। সে জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সরকারকে এই নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা কি তা বোঝাতে হবে। আবশ্যকীয়তা ভালভাবে বোঝাতে হবে। নীতিমালার অনেক ভয়ঙ্কর দিক রয়েছে। যেগুলো গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। শুধু তাই নয়, এটা মিডিয়ার স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করবে। এধরনের নীতিমালা গণতান্ত্রিক দেশে খাপ খায় না। এটা তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যও সন্তোষজনক নয়। এই নীতিমালার বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রতিবাদ করতে হবে। সম্প্রচার কমিশনের মাধ্যমে নীতিমালা করার দাবি জানান তিনি। আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে হুমায়ূন কবীর হিরু, রেহানা সিদ্দিকী, ইঞ্জিনিয়ার মুসবাহ আলীম, এম এ সিদ্দিকী প্রমুখ অংশ নেন।

No comments

Powered by Blogger.