দুদকের জালে তিন নেতা

ক্ষমতাসীন দলের তিন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁরা হলেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান, পটুয়াখালী-৪ আসনের বর্তমান সাংসদ ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান এবং কক্সবাজার-৪ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান ওরফে বদি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর রমনা থানায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এঁদের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় পৃথক তিনটি মামলা করেন দুদকের তিন উপপরিচালক। এর আগে দুপুরে দুদকের নিয়মিত বৈঠকে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, এঁরা তিনজনই দুদকের কাছে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপন করেছেন এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। মান্নান খান চার লাখ ৫৯ হাজার ৫৯৭ টাকা মূল্যমানের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে তিনি ৭৫ লাখ চার হাজার ২৬২ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন।
মাহবুবুর রহমান এক কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন এবং পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
আর আবদুর রহমান বদি সম্পদ বিবরণীতে ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৬৯ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী দুই সাংসদ ও সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের এই মামলা দায়েরের ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। গতকাল রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা করে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল দুদক। আমরা এ রকমই চাই। তবে পরিচয়, অবস্থাননির্বিশেষে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে পারলেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বাস্তব অগ্রগতি হবে এবং এর ফলে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।’
বিগত মহাজোট সরকারের সাত মন্ত্রী-সাংসদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির অভিযোগ উঠলে দুদক গত ২২ জানুয়ারি তা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী হলফনামাকে ভিত্তি করে এই অনুসন্ধান শুরু হয়। এরপর প্রায় আট মাস অনুসন্ধান শেষে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো।
এখনো চারজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। তাঁরা হলেন বিগত মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, ঢাকার আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামুল হক ও রাজশাহীর সাংসদ এনামুল হক এবং সাতক্ষীরার জাতীয় পার্টির সাংসদ এম এ জব্বার। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলামের কাছে পরাজিত হন।
তবে এর আগে টাকার বস্তা কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তাঁর ছেলে সৌমেনকে নির্দোষ ঘোষণা, পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় সাবেক দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে ছাড় দেওয়া, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান না করা, ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বিতর্কিত হল-মার্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় একজন উপদেষ্টার সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে দুদকের সমালোচনা রয়েছে।
আবার দু-একটি ঘটনায় সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও এখন পর্যন্ত সাজা হয়নি কারও। এবার তিন নেতার মামলার সর্বশেষ অবস্থা কী দাঁড়াবে বা সরকারের পক্ষ থেকে চাপ এলে তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা আছে দুদকের মধ্যেই।
দুদকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির কোনো মন্ত্রী-নেতা হলে চিন্তা ছিল না। সরকারদলীয় বলে ভেতরে ভেতরে অনেক অস্থিরতা কাজ করছে।
দুদক সূত্র জানায়, এই তিন মামলার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে দুজন কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করা হয়েছে। সাংসদ বদির বিরুদ্ধে শুরুতেই জোরেশোরে অনুসন্ধান করেন উপপরিচালক আহসান আলী। প্রথমে তাঁকে বদলি, পরে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। আর সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ-সংক্রান্ত অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে রাজশাহী জেলা কার্যালয়ে।
মান্নান খানের বিরুদ্ধে মামলা: দুদকের উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন এ মামলার এজাহারে জানিয়েছেন, সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী দুদকে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে চার লাখ ৫৯ হাজার ৫৯৭ টাকা মূল্যমানের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে ৭৫ লাখ চার হাজার ২৬২ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন।
মাহবুবুর রহমান: দুদকের উপপরিচালক খায়রুল হুদা বাদী হয়ে এ মামলা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন এবং দুদকের কাছে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে আরও এক কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ রয়েছে।
হলফনামায় স্ত্রী প্রীতি হায়দারের কাছ থেকে ২০০৮-০৯ করবর্ষে ৪০ লাখ এবং ২০১০-১১ করবর্ষে এক কোটি টাকা পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ করবর্ষে প্রীতি হায়দার প্রথম কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) গ্রহণ করেন এবং ২০১০-১১ করবর্ষে প্রথম রিটার্ন দাখিল করেন। অন্যদিকে ওই করবর্ষে প্রীতি হায়দার ব্যবসা করে তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন এবং সম্পদ ও দায়-বিষয়ক আইটি-১০বি ফর্মে প্রীতি তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা পেয়ে এক কোটি টাকা স্বামী মাহবুবুর রহমানকে দিয়েছেন বলে লিখেছেন। কিন্তু ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার ও স্বামীকে টাকা দেওয়ার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
একইভাবে হলফনামায় জনৈক বিপুল হাওলাদারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন মাহবুবুর রহমান। কিন্তু বিপুল হাওলাদার এ অর্থ দেননি বলে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়ে দিয়েছেন।
হঠাৎ মাছ চাষ করে ২০১১-১২ করবর্ষে দুই কোটি টাকা আয় ও ২০১৩-১৪ করবর্ষে দেড় কোটি টাকা এবং মেয়ের বিয়ের উপহার হিসেবে নগদ ৮০ লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানালেও দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মাছ চাষ থেকে আয়ের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাননি। আর মেয়ের বিয়ের উপহার হিসেবে নগদ অর্থ প্রাপ্তির সপক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও মেলেনি।
তাঁর আয়কর নথি পর্যালোচনা করে দুদক দেখেছে, মোট পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয়ের কোনো বৈধ উৎস নেই। এই অর্থ তিনি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অর্জন করেছেন।
আবদুর রহমান বদি: কক্সবাজার-৪ আসনের এ সাংসদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৬৯ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপন এবং অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের বৈধতা দেখাতে কমদামি সম্পদকে বেশি দাম (এক কোটি ৯৮ লাখ তিন হাজার ৩৭৫ টাকা) দেখানোর অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান।
দুদক নোটিশ দিলে বদি প্রায় ১১ কোটি টাকা সমমানের বিভিন্ন ধরনের সম্পদের তথ্য গোপন করেন। বদি নিজ নামে ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে মাত্র পাঁচ কোটি ২০ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৮ টাকার তথ্য দুদকের সম্পদ বিবরণীতে দাখিল করেছেন। অথচ বিভিন্ন করবর্ষের আয়কর নথি থেকে দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৩০ জুন ২০১৩ পর্যন্ত বদির মোট আয় ১৬ কোটি ছয় লাখ ৯৬ হাজার ২০৭ টাকা। এ ছাড়া সম্পদ অর্জনের উৎস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার কথা বললেও বদি দুদকের কর্মকর্তার কাছে এ-সম্পর্কিত কোনো প্রমাণাদি দেখাতে পারেননি।

No comments

Powered by Blogger.