ঈদের পর মাঠ দখলের লড়াই

ঈদের পর সরকার পতন আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন ২০ দলীয় জোট নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। মাঠেই দেখা হবে বলে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উভয় জোটের সিনিয়র নেতারাও দিচ্ছেন পাল্টাপাল্টি হুঁশিয়ারি। এই পরিস্থিতিতে আবারও দেশে সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ। ঈদের পর রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি নিয়ে সবার মধ্যে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রহর গুনছেন সাধারণ জনগণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় দেশ আবারও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব সহিংস পরিস্থিতির দিকে এগোতে যাচ্ছে। ঈদের পর বিএনপি মাঠে নামলে এবং সরকার তা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নামালে নিশ্চিতভাবেই তা সংঘাতের জন্ম দেবে। নিজ নিজ অবস্থানে কোন পক্ষ ছাড় না দিলে এ অবস্থার উন্নতি ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই। সে  ক্ষেত্রে জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ক আরও বাড়বে বলেও মনে করছেন তারা।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের আন্দোলনে ব্যাপক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। একদলীয় নির্বাচন ঠেকানোসহ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিরোধী পক্ষের কয়েক মাসব্যাপী আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ হতাহত ও সম্পদহানি হয়। কিন্তু আগে থেকেই দুই পক্ষকে সমঝোতার তাগিদ দিয়েছিল জাতিসংঘসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল। বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অব্যাহত তাগিদেও সৃষ্ট সঙ্কটের উত্তরণ ঘটেনি। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দফায় দফায় হস্তক্ষেপের পর হয়নি সমঝোতা। এই অবস্থায় অনেকটা একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয় ৫ই জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ওই নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে দল গুছিয়ে আন্দোলনে নামার কথা জানান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর রমজানে বিভিন্ন ইফতার পার্টির বক্তৃতায় ঈদের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন তিনি। সরকার আন্দোলন মোকাবিলার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এবং গুলি করেও তা ঠেকানো যাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন খালেদা জিয়া। এছাড়া আন্দোলন সফল করতে আগের কমিটি বিলুপ্ত করে ঢাকা মহানগরের নতুন আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করেছেন খালেদা জিয়া। এদিকে বিএনপির আন্দোলনের হুঁশিয়ারির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আন্দোলন করতে তারা মাঠে নামুক না। মাঠের দেখা মাঠেই হবে। ফুটবল খেলা মাঠেই হয়। খেলা হবে মাঠেই। দুই নেত্রীর পাল্টাপাল্টি হুমকিতে চরম আতঙ্কে ভুগছে দেশের সাধারণ মানুষ। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঈদের পর দখলদার ও অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এই শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনে শরিক হবেন আশা করি। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আমরা পাঁচ বছর ধরে আন্দোলন করছি। ঈদের পর আবার সেই আন্দোলন শুরু হবে। জনগণের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। মির্জা আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সাক্ষাৎকারে সংলাপ সমঝোতার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তারা সংলাপ চাচ্ছেন না। সংলাপ-সমঝোতা না হলে বিএনপির সামনেও আন্দোলন ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। ওদিকে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, দুনিয়ার কোথাও বলা নেই নির্বাচনের আগে সংলাপ করতে হবে। তাই সংলাপের প্রশ্নই আসে না। নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস বলেছেন, ঈদের পর ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে সরকার পতন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিএনপি এবং বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সরকার বিএনপির আলোচনার আহ্বান অগ্রাহ্য করলে রাজপথে তুমুল যুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাবে। তবে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, বিএনপি বলছে আন্দোলনে যাবে। আওয়ামী লীগও প্রস্তুত। ঈদের পর আমরা বিএনপিকে রাজপথেই মোকাবিলা করবো।  খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য করলে তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে সরকারের বাধা দেয়ার কোন পরিকল্পনা নেই। ২০১৩ সালের মতো  নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করলে অবস্থা খারাপ হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপির আন্দোলন কার জন্য, কিসের আন্দোলন? তারা সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষ আর বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চান না। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই। তিনি বলেন, আমরা আগামী সাড়ে চার বছর ক্ষমতায় থাকবো। ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। সাড়ে চার বছরে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করা হবে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। কারণ শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা রয়েছে। আওয়ামী লীগের এ সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বলেন, ঈদের পর আমরা সারা দেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করবো। জেলা সম্মেলন, সভা-সেমিনার, সমাবেশ করে সংগঠনকে শক্তিশালী করা হবে যাতে বিএনপি-জামায়াত চক্রের যে  কোনো আন্দোলন সাংগঠনিকভাবে মোকাবিলা করা হবে।
এদিকে সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে মানুষ পরিত্রাণ চায়। আর জাতীয় পার্টিই পারে আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। বর্তমানে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল। আগামীতে জাতীয় পার্টি ১৫১ আসনের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। লক্ষ্য সরকার গঠন করা। একদিকে সংগঠনকে শক্তিশালী করবো। অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে ঢাকার পাশের জেলাগুলোতে জনসভা করবো। পর্যায়ক্রমে সাতটি বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশ শেষে ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীতে সম্মেলন হবে। আগামী বছরের প্রথম দিন থেকে নতুন উদ্যোগে জাতীয় পার্টির পথচলা শুরু হবে। সরকারের সফলতা ব্যর্থতা গণমুখী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংসদে ও রাজপথে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

No comments

Powered by Blogger.