নাজাত লাভের জন্য তওবা করুন

রমজান মাসে তওবার মাধ্যমে রোজাদারের পাপমুক্তি, ক্ষমাশীলতা ও নাজাতপ্রাপ্তির পথ সুগম রাখা হয়েছে। ‘তওবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ফিরে আসা বা বিরত থাকা অর্থাৎ তওবা করে পাপাচার ত্যাগ করে পূর্বাবস্থায় ফিরে এসে সৎ পথে চলা। শরিয়তের পরিভাষায় শয়তানের প্ররোচনায় কোনো পাপকাজ করে ফেললে তা বুঝে আসামাত্র দুঃখিত-অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা তাৎক্ষণিক পরিত্যাগ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে এই প্রতিজ্ঞা করা যে, ভবিষ্যতে তা আর কখনোই করব না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা অসৎ কাজ করে তারা পরে তওবা করে অনুতপ্ত হলে ও ইমান আনলে তোমার প্রতিপালক তো পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৫৩) আল্লাহর দরবারে রোজাদারের মর্যাদা অনেক বেশি। কিয়ামতের দিনও রোজাদারকে সাদরে গ্রহণ করা হবে। রোজাদারদের ওপর যেন সর্বদা আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে, তাই সারা জীবনে কৃত ভুল ও পাপস্খলনের জন্য তওবা ও ইস্তেগফার করা দরকার। পাপীকে অতীত মন্দকাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, বিশুদ্ধ তওবা, সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে; যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত।’ (সূরা তাহরিম, আয়াত: ৮) 
বিশুদ্ধ তওবা’ হলো ১. কৃত গুনাহর জন্য অনুশোচনা করা ২. সেই গুনাহর জন্য আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ৩. ভবিষ্যতে এই গুনাহ না করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া। অপরাধ করার পর যত শিগগির পারা যায় তওবা করা সমীচীন। গুনাহ থেকে তওবা করা ওয়াজিব। যদি পাপ আল্লাহ ও বান্দাসংশ্লিষ্ট হয় তখন আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে তওবা করা উচিত। গুনাহর কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বারবার তাগিদ দিয়ে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি পাপকাজে নিয়োজিত হয়, তখন তার কলবে পাপের একটি কালো চিহ্ন অঙ্কিত হয়। যদি সে পবিত্র চিত্তে তাওবা করে (অর্থাৎ এ কাজ আর করবে না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়) এবং কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে, তবে ওই কালো চিহ্ন ধৌত হয়ে যায়। আর যদি তওবা না করে আরও গুনাহ করে তাহলে কালো দাগ বিস্তার লাভ করতে থাকে। এভাবে কলব একেবারে কালো হয়ে যায়।’ (তিরমিজি) হজরত মুআজ (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন অসিয়ত করে বলেন, ‘সাবধান! নিজকে গুনাহ থেকে বিরত রেখো! কারণ গুনাহ করলে আল্লাহর গজব নাজিল হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ) তিনি আরও বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে আসল রোগ এবং খাঁটি ওষুধের কথা বাতলে দিচ্ছি। তোমাদের আসল রোগ হলো ‘গুনাহ’ আর খাঁটি ওষুধ হলো তওবা করা।’ (বায়হাকি)
যদি পাপাচার দুজন বান্দাসংশ্লিষ্ট হয় তাহলে তওবাকারীকে হকদার ব্যক্তির প্রাপ্য আদায় করতে হবে। যদি ধনসম্পদের ব্যাপার হয় তবে তা ফেরত দিতে হবে। কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে ভবিষ্যতে আর কোনো গুনাহ করবে না। আর যদি গিবত করা হয়ে থাকে তাহলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। অপরাধী যখন অনুশোচনায় সিক্ত হয়, অন্যায় ও অপরাধকর্ম থেকে বিরত হওয়ার প্রতিশ্রুতিতে পাপমুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে হাজির হয়, তখন আল্লাহ তাকে দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকের তওবা গ্রহণ করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং অতিসত্বর তওবা করে। এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করেন। তওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হলে বলে, আমি এখন তওবা করছি এবং তাদের জন্যও নয় যাদের মৃত্যু হয় কােফর থাকা অবস্থায়।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৭-১৮) নবী করিম (সা.) এমন মানুষদের জন্য আক্ষেপ করেছেন, যারা রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাতের পবিত্র মাহে রমজান জীবনে পেয়েও গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ইমান আনার পর যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং যাদের সত্য প্রত্যাখ্যান প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না, এরাই পথভ্রষ্ট।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯০)
নবী-রাসুলগণ নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও উম্মতের গুনাহখাতা মাফের জন্য এবং মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহানবী (সা.) তওবা করতেন। হাদিস শরিফ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবা মৃত্যুকালীন কষ্ট শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কবুল করে থাকেন। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আল্লাহর কাছে তোমাদের গুনাহর জন্য তওবা করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আমার প্রতি লক্ষ করো! আমি প্রত্যহ শতবার করে আল্লাহর কাছে তওবা করে থাকি।’ (মুসলিম) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘বান্দা গুনাহ করার পর তওবা করলে আল্লাহ সে ব্যক্তির ওপর ওই ব্যক্তির চেয়ে অধিক খুশি হন যে ব্যক্তি নিজের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উট কোরনা ময়দানে হারিয়ে যাওয়ার পর তা হঠাৎ পেয়ে গেলে খুশি হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) তাই আমরা যেন ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় পঞ্চ স্তম্ভসহ শরিয়তের সব বিধিবিধান মেনে চলে নামাজ, রোজার হুকুম-আহকাম সম্পূর্ণভাবে পালন করে তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে মাহে রমজানের অশেষ রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভ করতে পারি! হে আল্লাহ! রমজান মাসের শেষ দশকে তওবার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি করুন এবং পাপকাজ করার পরপরই যাতে আপনার কাছে তওবা করতে পারি, সেই তাওফিক দান করুন!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.