নারায়ণগঞ্জে কারেন্ট জালের রাজনীতি by মিজানুর রহমান খান

নারায়ণগঞ্জের উপনির্বাচনযজ্ঞ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনের সময় সামাজিক শক্তি যতটা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, রাজনৈতিক দল তা পারে না। কারণ, দলগুলো অনেক বেশি অগণতান্ত্রিক ও কোটারি শক্তির সঙ্গে আপস করে চলে। সেখানে ব্যক্তি ও তার দল চাইলেই সামাজিক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না। তাকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপস করতে হয়। সে কারণে বিএনপির মতো দল, যারা বর্তমান সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল, তারা আজকের উপনির্বাচনে দলগতভাবে কোনো পরোক্ষ বার্তা প্রকাশ করতে পারেনি। সে কারণে কেন্দ্র দখলের মতো কোনো ঘটনা ঘটলেও তা প্রতিরোধে বিএনপি অপ্রস্তুত থাকবে৷ প্রতিরোধপর্ব যাতে কার্যকরভাবে জমে উঠতে না পারে, সে জন্য বহুধারায় বিভক্ত স্থানীয় বিএনপিকে অধিকতর দুর্বল করে রাখা হয়েছে।

জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে হলেও বলেছিলেন, মানুষ সন্ত্রাসী ও গডফাদারকে ভোট দেবে না। বিএনপির আমলে তাঁর নিহত ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি বিএনপির আরেক সাংসদ গিয়াসউদ্দিনকে (মি. উদ্দিন বর্তমানে দলের সঙ্গে আলগা সম্পর্ক রেখে চলেন, অনেকটা নিষ্ক্রিয়, বললেন, খন্দকাররা তাঁকে ভুল বুঝেছেন) দায়ী করেন৷ আবার পার্বত্য চুক্তিবিরোধী এক মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনায় একজন নিহত এবং নিজের গায়ে দুটি বুলেট আজও বহনের ঘটনায় তৈমুর ওসমানদের ওপর দায় চাপান৷ লন্ডনে পাড়ি জমানোর আগের রাতে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। এ নির্বাচনে আকরাম জয় পেলে বিএনপি কোনোভাবে লাভবান হতে পারে, সেই চিন্তা তাঁর নেই। তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রত্যাশী তৈমুর আলমের দেশত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ভাই খোরশেদ আলম খন্দকার—যিনি একজন কাউন্সিলর ও বিএনপির নেতা, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর ছবি দহলিজে শোভিত, হোলস্টারে সারাক্ষণ পিস্তল রাখেন, তিনি হজব্রত পালন করতে শহর ছেড়ে যান৷ কিন্তু তৈমুরপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল, যিনি সর্বশেষ কাউন্সিলে গোপন ব্যালটে নির্বাচিত একমাত্র নেতা, ক্রমাগত বিবৃতি দিচ্ছেন যে বিএনপি ভোট বর্জন করেছে ঠিকই; কিন্তু বিএনপি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, যারা জিয়া পরিবারকে হেনস্তা করেছে, তাদেরকে ‘ভোট’ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চাষাঢ়ার মোড়ে যেখানে জেনারেল জিয়াউর রহমান শহরের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল খেলার মাঠ নষ্ট করে জিয়া ক্লাব বানানোকে উৎসাহিত করেছিলেন, সেখানে রাখা জিয়ার ম্যুরালে ওসমানেরা কালি লাগিয়েছিলেন। কামালই তা মুছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
ভোট কথাটির উচ্চারণ যে সাংগঠনিক অবস্থানের পরিপন্থী, সেটা চিহ্নিত করে তাঁকে চাপে ফেলার মতো নেতা-কর্মীর আকাল পড়েনি। এমনকি তাঁকে বহিষ্কারের কথাও প্রচারিত হয়েছিল। অথচ তিনি তেমন মাপের নেতা নন৷ এই আসনের বিএনপির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সম্ভাব্য প্রার্থী তফাতে রইলেন। তৈমুর লন্ডনে আর অপর বিএনপির নেতা আবুল কালাম, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে অাকরামকে অল্প ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন, যথাসম্ভব কম সক্রিয়। তিনি যদিও সরাসরি ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ভোট না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী, যিনি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, বিএনপিপন্থীর তকমা তাঁর গায়ে এখনো লেপ্টে আছে, যঁাকে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পরে সেলিম ওসমানের পোশাক কারখানা উইজডোম অ্যাটায়ার্সের ‘অবৈধ’ দখলদারত্ব থেকে নাটকীয়ভাবে উৎখাতের ঘটনায় ওসমান পরিবারের পক্ষে মধ্যস্থতা করতে দেখা গিয়েছিল, তিনি লাঙ্গলের পক্ষে সক্রিয় থেকেছেন।
১২ নম্বর ওয়ার্ডের সিটি কাউন্সিলর শওকত হোসেন ওরফে শকু বিএনপির স্থানীয় নেতা, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বেকসুর খালাস পাওয়া আসামি কিসমতের ভাই, বোমা হামলায় ২০ জনের নিহত হওয়ার ওসমানীয় মামলার অন্যতম আসামি৷ শামীম সুযোগ পেলেই কিসমতের ভাইকে ‘প্রশ্রয়’ দেওয়া নিয়ে আইভীকে ঠেস দেন৷ অথচ শকু লাঙ্গলের পক্ষে ভোট চাইছেন। তিনি অবশ্য এটা অস্বীকার করেন। প্রশ্নের জবাবে শামীম ওসমান আমাকে বলেছিলেন, বোমা হামলায় শকুর জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দেন না। ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন দেওয়ান লাঙ্গলের পক্ষে ভোট চাইছেন। বন্দর উপজেলা থেকে বিএনপির সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ওরফে মুকুলের ব্যবসা খুব পরিচ্ছন্ন নয় বলে অভিযোগ আছে। তিনি সতর্কতার সঙ্গে হলেও লাঙ্গলের পক্ষে নামেন। এ টি এম কামাল ছাড়া বিএনপির অন্য যিনি আনারসের পক্ষে জোরসে নেমেছেন, তিনি আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান। সেটাও সম্ভবত তিনি মূলধারার বা ঢাকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আলগা বলেই। বিএনপি–বিদ্রোহী হিসেবে বারের সভাপতি হন।
খালেদা জিয়া এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা ওসমান পরিবারের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে বিব্রত ও পীড়িত। ত্বকী এবং সেভেন মার্ডারের অসাধারণ সংবেদনশীল প্রেক্ষাপট বিএনপি নেত্রীকে গঞ্জের ভুক্তভোগী পরিবারের শরণাপন্ন করেছিল, কিন্তু তা অতটুকুই৷ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের পাশে মওদুদ আহমদরা দাঁড়ালে এর সুফল নাগরিক সমাজের প্রার্থী আকরাম পেতেন৷ কিন্তু ‘অবৈধ’ উপনির্বাচন বর্জনের যান্ত্রিক অবস্থানে তঁারা সম্ভবত অাঁচড়টুকুও কাটতে চাননি৷ দলের লাভ কী। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আকরাম সচিব থাকলেও তাঁদের মধ্যে বাতচিত তেমন হয়নি। ফুলের তোড়া হাতে আকরাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। তাই প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা একটি বিতর্কিত পরিবারের পাশে থাকার অভাবনীয় ঘোষণা এবং তাতে শান্তিকামী মানুষের আহত বোধের বিষয়টি বিএনপির নেত্রীকে কোনো কৌশল গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেনি। রুহুল কবির রিজভী ভোট না দেওয়ার ডাক দিয়েছেন৷ এর তাৎপর্য অস্পষ্ট নয়৷ স্থানীয় একজন সাংবাদিক মঙ্গলবার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রিজভী তখন বলেন, ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন কি যাবেন না, তা তিনি বলেননি।
কাকতালীয় যে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক যেভাবে প্রকাশ্যে আকরামকে, তেমনি তাঁর শাসকদলীয় প্রতিপক্ষ খোকন সাহা ওসমানকে সমর্থন করছেন। গতকাল এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই রকম খবর পেলাম। একজন টিভিব্যক্তিত্ব বললেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আকরামই জয় পাবেন। আরেকজন যিনি প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সঙ্গী ছিলেন, তিনি আমাকে বলেন, কেন্দ্র দখলের প্রস্তুতি আছে৷ সেলিম ওসমান জানিয়েছিলেন, তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ নির্বাচন করবেন না। পরে মত পাল্টান।
ওসমান পরিবারের সদস্যরা অতীতে অনেক দুঃসময় অতিক্রম করেছেন। বিদেশে তাঁদের পালিয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এমন দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেননি। এবারে দিয়েছেন এমন একটি প্রেক্ষাপটে, যখন সাত খুনের সন্দেহের তিরে ওসমান পরিবার বিদ্ধ। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর প্রতিপক্ষের অবস্থান বা কৌশলে কোনো পরিবর্তন আসেনি। গঞ্জবাসীর প্রতি খালেদা জিয়ার কোনো অঙ্গীকার আছে, তা বলা যাবে না; বরং একজন জনপ্রিয় রাজনীতিক আমাকে বলেছেন, বিএনপির উচ্চপর্যায়কে হাত করার খবর তাঁরা শুনেছেন। এটা ঠিক-বেঠিক যা-ই হোক, বিএনপির ঔদাসীন্য স্পষ্ট। অবশ্য বিএনপির বিপুল নেতা–কর্মী নাগরিক শক্তির পক্ষে খেটেছেন৷ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পনগর, যেটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম কেন্দ্র, যেখানে বছরে কয়েক ডজন গুম–খুন হয়, সেখানে একটি নির্বাচন হচ্ছে, যার সঙ্গে বর্তমান সরকারের টিকে থাকা, বর্তমান সরকারের বৈধতার প্রশ্ন সবচেয়ে ঠুনকো, সেখানেও কারচুপির আশঙ্কা প্রবল৷ সবকিছু ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সন্ত্রাস, না শান্তি, সেটা অনেকাংশে প্রতীকী হলেও তারও তো একটা পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। অথচ সেখানে দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল কথিতমতে নিরপেক্ষ থাকার ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে।
মঙ্গলবার মির্জা ফখরুল ইসলামকে বললাম, বর্জনের তকমা বজায় রেখেও একটি পরোক্ষ অবস্থান স্পষ্ট করতে পারতেন, কিন্তু করেননি৷ ভোট বর্জনের দিকেই বিএনপির ঝোঁক, যা ওসমান পরিবারকেই শক্তি জোগাবে। অপরাজনীতির কারেন্ট জালে বিএনপি এভাবেও বন্দী৷
সাধ্য কী যে আইভী ও আকরামও সহজে এর বাইরে বের হন। মেয়র পদে থেকে আইভীর তো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার আইনগত সুযোগ ছিল না৷ তাই তাঁকে কৌশলী হতে হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের শেষ কমিটির আহ্বায়ক আকরাম পদত্যাগ করেছেন। সেটা গ্রহণ বা নাকচ হলো কি না জানা যায় না। যুগ্ম আহ্বায়ক মারা গেছেন। গঞ্জের আওয়ামী লীগ তাই মরূদ্যান হয়ে শূন্যে ভাসছে।
রাজনীতি ও সুশাসন কোনোটিই গঞ্জে নেই। শামীম ওসমান তিন ঘণ্টার বেশি গঞ্জের ঘটনাপ্রবাহ তাঁর মতো করে ব্যাখ্যা করেও গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন। আমাকে বলেন, তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিতে পারেন!
জয়ী হলে আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন? শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ জানালে তাঁকে ফেরাবেন? এস এম আকরাম আমাকে এ সম্ভাবনা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নাকচ করে দেননি। কারণ, রাজনীতিটা কারেন্ট জালে আটকা। বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখন নয়৷
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.