নূর হোসেনের যত বড় ভাই! by সোহরাব হাসান

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নূর হোসেনই আলোচনায় ছিলেন৷ ১৯৮৭ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নায়ক৷ সেই নূর হোসেন বুকেপিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে এরশাদের স্বৈরশাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন৷ সব স্বৈরশাসকের মতো এরশাদও এ রকম একজন সাহসী ও দ্রোহী যুবককে সহ্য করতে পারেননি৷ প্রকাশ্য রাজপথে মিছিলরত এই অকুতোভয় যোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ সেই নূর হোসেন ছিলেন আমাদের লাখো লাখো ছাত্র ও তরুণের আদর্শ৷ গণতন্ত্রের আশা ও বিশ্বাস৷ তাঁর সাহস ও ত্যাগের পথ ধরে নব্বইয়ে এরশাদের পতন হয়েছে সত্য, গণতন্ত্র মুক্তি পায়নি; বরং আড়াই দশকের ব্যবধানে স্বৈরাচারের সব বদগুণ ও বদ–অভ্যাস আমাদের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জেঁকে বসেছে৷ সেদিন নূর হোসেনকে গুলি করে যে স্বৈরাচারী হত্যা করেছিল, সেই স্বৈরাচারী এখন গণতান্ত্রিক সরকারের অংশীদার৷ পৃথিবীর সব স্বৈরাচারকেই হয় দেশত্যাগ করতে হয়, নয় বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ পিনোচেট, মার্কোস, ইরানের শাহ—কেউ দেশে থাকতে পারেননি৷ কিন্তু বঙ্গদেশীয় স্বৈরাচার বহাল তবিয়তেই আছে৷ তিনি কেবল সরকারের অংশীদার নয়, ‘গণতন্ত্রী’ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত৷ আবার একই সঙ্গে জেনারেল মঞ্জুর হত্যার আসামিও৷

রাজনীতিতে যখন নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ নির্বাসিত হয়, যখন স্বপ্ন ও বিশ্বাস হারিয়ে যায় তখন শহীদ নূর হোসেনদের কথা কেউ মনে রাখেন না৷ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ পরিত্যক্ত হয়৷ আর তাদের শূন্য স্থান পূরণ করে নারায়ণগঞ্জের, লক্ষ্মীপুরের, ফেনীর সন্ত্রাসী ও খুনিরা। সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন এক ভয়ংকর সন্ত্রাসী৷ সাত খুনের আগ পর্যন্ত তাঁর সব অপকর্ম ও অপরাধ চাপা ছিল৷ এখন দিনের অােলার মেতা প্রকাশিত৷ আবার এ কথাও ঠিক যে নূর হোসেনরা একা দানব হতে পারেন না। এই সমাজেই তাঁর আশ্রয়দাতা, অস্ত্রদাতা ও মন্ত্রদাতা আছেন৷ আছেন তাঁর বড় ভাই, মেজো ভাই, ছোট ভাই৷ আছেন মাসোহারাভোগী, চাঁদা গ্রহণকারী ও চাঁদা প্রদানকারী৷ একটি সমাজ কতটা পচে গেলে, নষ্ট হলে রাজনীতি কতটা দূষিত হলে এ রকম একজন ব্যক্তিকে দুধকলা দিয়ে পোষা হয়। সমাজের অনেক ভদ্র লেবাসধারী ব্যক্তিরও নাকি তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতে বাধেনি। নূর হোসেন সবকিছু টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছিলেন— বাড়ি, গাড়ি, বিত্তবৈভব, রাজনীতি, পদপদবি৷ এমনকি টাকা দিয়ে সাতজন মানুষকে খুন করাতেও তাঁর বাধেনি৷ তিনি ভেবেছেন, আইনের ঊর্ধ্বেে থাকবেন৷ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন৷ তাঁর বড় ভাই, মেজো ভাই ও ছোট ভাইয়েরা বাঁচাবেন৷ কিন্তু শেষরক্ষা হলো বলে মনে হয় না৷
সম্প্রতি কলকাতার আদালতে নূর হোসেন বলেছেন, তিনি সাত খুনের ঘটনায় জড়িত নন৷ তিনি রাজনীতির শিকার৷ তিনি স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়েননি৷ দেশ ছেড়েছেন তাঁর নেতা ও বড় ভাইদের পরামর্শে৷ আমরা জানি না নূর হোসেনের নেতা ও বড় ভাই কারা? তাঁরা কি নারায়ণগঞ্জেই সীমাবদ্ধ, নাকি রাজধানীর অভিজাতপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত? তবে আমরা অন্তত তাঁর একজন বড় ভাইয়ের নাম দেখেছি, যিনি টেলিফোনে তাঁকে পাসপোর্টে সিল আছে কি না জানতে চেয়েছেন, যিনি জনৈক গৌরদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন৷ উল্লেখ্য, এই বড় ভাইয়ের হাত ধরেই নূর হোসেন ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় পিজিপিতে (প্রেজেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি) যোগ দিয়েছিলেন৷ আবার ২০০১ সালে তাঁর সঙ্গেই পাালিয়ে গেছেন। কী অদ্ভুত আত্মিক বন্ধন৷ নূর হোসেন কেবল সুদিনের বন্ধু নন, দুর্দিনেরও সহযাত্রী।
তবে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ রকম বহু ভাই ও নেতা অাছেন ফেনীতে, লক্ষ্মীপুরে, বরিশালে, পাবনায়, সিলেটে, যশোরে; যারা নূর হোসেনদের আশ্রয় ও অভয় দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া আছেন। তাঁরা একেকজন নূর হোসেন, একেকজন ইমদু (বিচারপতি সাত্তারের আমলে একজন প্রতিমন্ত্রীর বািড় থেকে যিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন), একেকজন আজম খান (যিনি আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিনকে হত্যা করেছিলেন) তৈরি করেন। এই তিন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী তিন আমলে তৈরি৷ এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী কিংবা স্বৈরাচারী আমলের মধ্যে ফারাক নেই৷ অপরাধী যত ভয়ংকরই হোক না কেন, একা সে অপরাধ করতে পারে না৷ নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেনও পারেননি৷ আমাদের এই সমাজ ও রাষ্ট্র এতটাই নিষ্ঠুর ও নির্বিকার যে এত দিন নূর হোসেন এসব অপকর্ম নির্বিঘ্নে করে যেতে পেরেছেন৷ আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেনি৷ একটি সমাজ ধ্বংসের কিনারে গেলেই এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে৷
খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যে এই ব্যক্তি করেননি৷ আর আমাদের সমাজ, আমাদের সরকারি দল, আমাদের বিরোধী দল, আমাদের নাগরিক সমাজ, আমাদের সরকার ও প্রশাসন তা মুখ বুজে ‘অনুমোদন’ করে গেছে৷ এই সন্ত্রাসী নূর হোসেনই এখনকার বাংলাদেশের আদর্শ৷ আওয়ামী লীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টি—একে একে তিনি তিন দলেই সুবিধা নিয়েছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হয়েছেন৷ প্যানেল মেয়র পদেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন৷ সাত খুনের ঘটনা এভাবে দেশব্যাপী তোলপাড় না করলে হয়তো তিনি ভবিষ্যতে সাংসদও হতেন৷ আমরাও তা মেনে নিতাম।
এই নূর হোসেনদের স্থায়ী কোনো দল নেই৷ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতা-সাংসদেরাই নূর হোসেনের ভাই হয়ে যান৷ নাসিম ওসমানের হাতে তৈরি নূর হোসেন বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন৷ আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন৷ এই ধারায় চলে আসছে আমাদের রাজনীতি। যেই সমাজে খুদে মাফিয়া ডন নূর হোসেন সমাদৃত, সেই সমাজে গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেওয়া নূর হোসেনের কথা কেউ মনে রাখে না৷ নূর হোসেন এখন কলকাতায় জেলে আটক আছেন৷ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ফেরত আনার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু সেই চেষ্টা কত দিনে সফল হবে, আদৌ সফল হবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে৷ গ্রেপ্তারের আগে নূর হোসেন কলকাতার উপকণ্ঠে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতেন।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী নূর হোসেন ভারতে যাওয়ার সময় দুই কোটি টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছেন৷ কীভাবে তিনি এত টাকা নিয়ে গেলেন? কারা তাঁকে সহযোগিতা করেছে, পার হতে সাহায্য করেছে, সেটা কি কখনোই জানা যাবে? কেবল নূর হোসেন নন, বাংলাদেশের টাকা ও অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়, দুবাইয়ে, যাচ্ছে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে, জমা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে৷
কলকাতার আদালতে নাকি নূর হোসেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন৷ কী নিষ্কলুষ চরিত্র! নূর হোসেন বলেছেন, তিনি রাজনীতির শিকার৷ এক অর্থে তিনি ঠিকই বলেছেন৷ যে রাজনীতি খুনির চেহারা জনসমক্ষে উন্মোচন করে দেয়, হতে পারে তিনি সেই রাজনীতির শিকার৷ এর পর তাঁকে দেশে আনা হলে বলবেন, তিনি রাজনীতির শিকার। বিচার হলে বলবেন, রাজনীতির শিকার। কেননা এত দিন নূর হোসেনের পক্ষে আরও অনেক বড়, মেজো ও ছোট ভাই দাঁড়িয়ে যাবেন। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হয়তো তাঁদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না৷ এই প্রেক্ষাপটে আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে৷ কে জিতবেন—জনগণ যাকে ভোট দেবেন তিনি, নাকি যিনি ব্যালট বাক্স দখল করে নেবেন? নাকি ভোটের নামে সেখানে আরেকটি প্রহসন হবে?
প্রথম আলোর খবরে জানা যায়, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন—এমন ৩৬ জনের তালিকা তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি সংস্থা৷ ভোটারদের নিরাপত্তা এবং ভোটকেন্দ্রসহ এর আশপাশের এলাকায় শািন্তশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এসব ব্যক্তির ওপর কড়া নজরদারির সুপারিশ করেছে ওই সংস্থাটি৷ তালিকাভুক্ত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে মামলা রয়েছে৷ এঁদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ওসমান পরিবারের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত৷ এসব ব্যক্তির অনেকেই আবার র‌্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, অতীতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। এর মধ্যে নির্বাচনী এলাকার বাইরের বাসিন্দাও আছেন৷ এসব ব্যক্তি অর্থ ও পেশিশক্তির জোরে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারেন৷
ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান তাঁর নির্বাচনী এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা থেকে হাজার হাজার লোক নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷ প্রয়োজনে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখো মানুষ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ–৫ নির্বাচনী এলাকায় নিয়ে যেতে বলেছেন৷ এর উদ্দেশ্য কী? বাইরের লোকেরা তো ভোট িদতে পারবেন না, তাহলে কি ভোট ঠেকাতেই এই প্রস্তুতি? নির্বাচন কমিশন, নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই হুংকারকে কীভাবে নেয়, সেটাই দেখার বিষয়৷ নারায়ণগঞ্জের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকেরই দায়িত্ব তাঁদের ভোটের অধিকার রক্ষা করা এবং ভোট চোর ও ভোট ডাকাতদের রুখে দেওয়া৷
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.