বাজেট-বৈষম্য চলতেই থাকবে?

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যতবারই বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে, প্রতিবারই রংপুরের জনগণের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল বৈষম্যপূর্ণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পায়ন, যোগাযোগ, বিদ্যুতায়ন, গ্যাস-সংযোগ, অভিবাসী সংখ্যা—সবকিছুর পরিসংখ্যানে রংপুর বিভাগের অবস্থান দেশের সর্বনিম্ন অবস্থায়। যেহেতু বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়ন দেশে হয়েছে এবং দেশের সংবিধান অনুযায়ী পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাই আসন্ন ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটে রংপুরের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রংপুরের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের উন্নয়ন সর্বত্রই সমানভাবে হওয়া উচিত। রংপুরে যেহেতু উন্নয়ন সমানভাবে হয়নি, তাই কিছু কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ বরাদ্দ সাপেক্ষে বাজেট উপস্থাপন করা জরুরি। বাজেটে যদি রংপুরের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ না থাকে, তাহলে এ বছরও রংপুর উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে থাকবে। রংপুরের উন্নয়নের জন্য রংপুরে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। কিন্তু রংপুরে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পেছনে কয়েকটি অসুবিধা রয়েছে। যোগাযোগ, জ্বালানি এবং অর্থের অপ্রতুলতা এখানকার শিল্পায়নে বড় বাধা। সে জন্য রংপুরের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করা প্রয়োজন। শুধু জনগণের যাতায়াতের জন্য নয়, রংপুরে উৎপাদিত পণ্য যাতে অল্প সময়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেতে পারে, সে জন্য চার লেন অথবা ছয় লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন। যদি গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত ব্রহ্ম্পুত্র নদের ওপর একটি সেতু স্থাপন করা যায়, তাহলে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টায় রংপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছা সম্ভব হবে। কয়েক বছর আগে এই সেতু নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে রেলপথে ঢাকায় যেতে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত যেতে হয়। রংপুর থেকে সরাসরি যমুনা পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করলে রেল যোগাযোগে চার ঘণ্টা সময় কম প্রয়োজন হবে। জ্বালানির বিশেষ সুবিধা ছাড়া শিল্পকারখানা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সে জন্য রংপুরে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনয়ন করা প্রয়োজন। যদি স্বল্পতার অজুহাতে গ্যাস দেওয়া না হয়, তাহলেও দিনাজপুরের কয়লাশক্তিকে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যদি সেটি করাও সম্ভব না হয়, তাহলে শিল্পকারখানায় ব্যবহূত বিদ্যুতের মূল্য কমিয়ে, সেই সুবিধা শিল্প উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। অর্থের অপ্রতুলতা হেতু উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে রংপুর বিভাগের শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এই চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারলে রংপুরে শিল্পকারখানার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের প্রচুর ফলন হয়, প্রচুর লিচু হয়, আলু চাষেও রংপুর বিভাগ এগিয়ে, চা চাষের জন্য পঞ্চগড়ের মাটি খুবই উপযোগী। কৃষিজাত শিল্পকারখানার জন্য রংপুর উত্তম। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার পোশাকশিল্পে সবচেয়ে বেশি কাজ করে রংপুর বিভাগের শ্রমিক। রংপুরে যদি পোশাকশিল্প গড়ে তোলা যায়, সেটা থেকেও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। কুড়িগ্রামের বঙ্গ সোনাহাট স্থলবন্দরের সঙ্গে রেলসড়ক ও নৌপথে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। এই স্থলবন্দরকে উপযোগী করে ভারতের সেভেন সিস্টারস খ্যাত সাতটি রাজ্যে কসমেটিকস, কৃষিজাত শিল্পের বিশাল বাজার গড়ে তোলা সম্ভব। চিলমারী বন্দরকে যদি পুনরায় উপযোগী করে তোলা যায়,
তাহলে রংপুর বিভাগের জন্য বিশাল উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হবে। রংপুর বিভাগের সব জেলার সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগ রক্ষা করে চিলমারী বন্দর হয়ে দেশের সব বিভাগেই পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে। আসন্ন বাজেটে নদী খননের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তিস্তায় পানি পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে করে নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নদী খননের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। নদী বাঁচাতে না পারলে উত্তর জনপদে ভবিষ্যতে দুঃসহ পরিণতি নেমে আসবে। রংপুর নতুন সিটি করপোরেশন হয়েছে। এই সিটি করপোরেশনের আয় বাড়েনি। কিন্তু এর আয়তন অনেক বেশি। ২০৩ বর্গকিলোমিটারের এই নগরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্বের নামকরা যেকোনো নগরের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে এই নগর। সেই সম্ভাবনা এই নগরকে ঘিরে রয়েছে। এটি একটি মডেল নগরও হতে পারে, যা বাংলাদেশের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। সে জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান যেমন থাকা চাই, তেমনি প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিয়ে সত্যিকার অর্থে রংপুরকে নগরের মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন। রংপুর নতুন বিভাগ, নতুন সিটি করপোরেশন হিসেবে অন্যান্য বিভাগ সিটি করপোরেশনের চেয়ে তুলনামূলক অধিক বাজেটের দাবি রাখে। আসন্ন বাজেটে রংপুরের জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব সময় আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে হবে—এই ধারণাও পাল্টানো প্রয়োজন। দেশের অন্য কোথাও আন্দোলন করতে না হলে রংপুরের জন্য কেন আন্দোলন করতে হবে?
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.