জাগো বাহে কোনঠে নারায়ণগঞ্জবাসী by সোহরাব হাসান

গুম, খুন ও গুজবের শহর নারায়ণগঞ্জ। কেউ খুন হলে তার লাশ নদীতে ভেসে ওঠে। কেউ গুম হলে জীবিত বা মৃত উদ্ধার হয়। কিন্তু গুজব পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করে। অনাস্থা বাড়ায়। নারায়ণগঞ্জজুড়ে এখন নানা গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। শুক্রবার, ২ মে আতঙ্কের শহর নারায়ণগঞ্জে গিয়ে আরও একটি আতঙ্কের খবর পাই। সাত খুনের পর বৃহস্পতিবার রাতে আরও একজনকে অপহরণ করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রেসক্লাবে যেসব সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা বললেন, ওসব গুজব। দেখবেন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম আজ রাতের মধ্যে উদ্ধার হয়ে যাবেন।

যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহরণের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারল না, চার দিন পর তাঁদের লাশ শীতলক্ষ্যায় ভেসে উঠল, সেখানে সাইফুল ইসলামের ব্যাপারে তাঁরা এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে সাংবাদিক বন্ধুরা রহস্যের হাসি হাসলেন। অর্থাৎ, তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে এটি সত্যি সত্যি অপহরণের ঘটনা। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, যারা সাইফুল ইসলামকে অপহরণ করেছে, তারাই তাঁকে ফিরিয়ে দেবে।
অবশেষে ২৭ ঘণ্টা পর ঢাকা-আরিচা সড়কে সাইফুল উদ্ধার, তাঁর অপহরণকারী হিসেবে ঢাকায় কয়েকজনের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আসলে কে তাঁকে টেলিফোন করে ডেকে নিয়েছিল, কে তাঁকে ফিরিয়ে দিল—এসব যেন রহস্য উপন্যাসের কাহিনি । নারায়ণগঞ্জে প্রতিদিন একটি করে রহস্য উপন্যাস রচিত হচ্ছে। খুন ও অপহরণের ঘটনায় আমরা শিহরিত হচ্ছি। কিন্তু জানতে পরছি না খুনি কে। জানতে পারছি না এসবের পেছনে কারা আছে।
অপরাধী চক্রের হদিস সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। জানার কথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু তারাই যদি অন্ধকারে থাকে, তাহলে মানুষ কোথায় ভরসা পাবে? কেবল নারায়ণগঞ্জের হত্যা ও অপহরণ নয়, অনেক জায়গায়ই এ ধরনের গুরুতর অপরাধের ঘটনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা একে অপরের মুখোমুখি। পরস্পরের প্রতি সন্দেহের আঙুল তুলে আছে। র‌্যাব মনে করে, পুলিশের জন্য তারা অপরাধীদের ধরতে পারছে না। পুলিশের ধারণা, র‌্যাবই বড় বাধা।
নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-পুলিশের যেসব কর্মকর্তা এত দিন পদায়িত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে অপরাধ চক্রর সঙ্গে যোগসাজশের গুরুতর অভিযোগ আছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে বদলি করা হলেও নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকে সরিয়ে দিতে হবে। এক-দুজন কর্মকর্তাকে বদলি করলে কাজ হবে না। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না।
কয়েক দিন ধরেই নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সবাই কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেনের বিরোধের কথা বলছিলেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নজরুল নিরাপত্তা চেয়ে নাকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছিলেন। কেননা, নূর হোসেন প্রকাশ্যেই তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু স্থানীয় কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নজরুল ইসলামের নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চার সহযোগীসহ কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম অপহূত হন ২৭ এপিল দুপুরে, আদালত ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর। প্রকাশ্য দিবালোকে, রাস্তায় অনেক মানুষ ছিল। সাংসদ শামীম ওসমান দাবি করেছেন, ঘটনার ১৫ মিনিট পর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছেন। ঘটনার এক দিন পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম নূর হোসেন, ইয়াসিন প্রমুখকে আসামি করে মামলা করেন। কিন্তু আসামি নূর হোসেনের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালাল সাত দিন পর। এই সাত দিন অপেক্ষা করার কী যুক্তি ছিল?
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ওই দিন নূর হোসেনের বাড়িতে বৈঠক হচ্ছিল বলে তাঁরা খবর পেয়েছিলেন। তাহলে কি খুনের মামলার আসামির বাড়িতে অভিযান চালানোর জন্য আরেকটি খুনের বৈঠক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়? আশ্চর্য পুলিশের দায়িত্ববোধ!
শনিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি রক্তমাখা মাইক্রোবাসসহ নানা আলামত উদ্ধার করে। আর পরদিন নূর হোসেনের ব্যক্তিগত গাড়ি মিলল সাংসদ ও নূর হোসেনের দীক্ষাগুরু শামীম ওসমানের এক আত্মীয়ের কারখানায়। গুরু-শিষ্যের অটুট বন্ধন। শনিবার নূর হোসেনের বাসা থেকে যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁরা কেউ আসামি নন। আসামিদের সহযোগী। নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী জানান, হত্যার পরপরই পুলিশ অভিযান চালালে নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা ধরা পড়ত।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই অভিযান চালাতে এক সপ্তাহ দেরি করল? নারায়ণগঞ্জের নতুন পুলিশ সুপার বলেছেন, নূর হোসেন দেশেই আছেন। বিদেশে পালিয়ে যাননি। নারায়ণগঞ্জবাসীর মনে নানা প্রশ্ন, তিনি কোথায় পালিয়ে আছেন? কে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন? শুক্রবার শামীম ওসমান বলেছেন, নজরুলের হত্যাকারীরা ৩০ ফুট মাটির নিচে থাকলেও তাঁকে খুঁজে বের করা হবে। আপাতত তাঁর গাড়িটি উদ্ধার করা গেল এবং শামীম ওসমানের আত্মীয়ের কারখানা থেকেই।
উপর্যুপরি হত্যা ও গুমের পরিপ্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জবাসী মনে করেন, যেকোনো অঘটন ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রভাবশালী পরিবার পরস্পর পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। তাঁদের ধারণা, নারায়ণগঞ্জে যেসব বড় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার প্রতিটির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন। আর সেটি হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। এ থেকে যে উপসংহারে আসা যায় তা হলো, এত দিন অপরাধী চক্রের সঙ্গে অসুস্থ রাজনীতি যুক্ত হয়ে পড়েছিল। এখন তার সঙ্গে প্রশাসনের একাংশ সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। নারায়ণগঞ্জবাসীর আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত খুনিরা ধরা পড়বে না, খুনের বিচার হবে না। বরং বিচারের দাবি জানাতে গেলে হয়তো আরও কেউ খুনের শিকার হবেন। এ কারণেই অনেকে নীরব, হতাশ।
সাত খুনের পর নূর হোসেনের যে আমলনামা বেরিয়ে এসেছে, তা ভয়ংকর। তিনি ছিলেন ট্রাকের হেলপার। এখন হয়েছেন ধনকুবের। সন্ত্রাসের হোতা। আশির দশকে নূর হোসেন স্বৈরাচার এরশাদের দল করতেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদল হলে আওয়ামী লীগে আসেন। সেই থেকে তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে নিজেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। নারায়ণগঞ্জে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাঁর আয়ের প্রধান উৎস অবৈধ বালু ব্যবসা ও পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি। সেই চাঁদার ভাগ পেতেন অনেকেই। বিআইডব্লিউটিএ একাধিকবার তাঁর অবৈধ বালু ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়। একবার বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয় নূর হোসেনের লোকজন।
প্রশ্ন জাগে, দুর্বৃত্তায়ন যাঁর নেশা ও পেশা, সেই ব্যক্তি কীভাবে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হলেন? তাহলে কি জনগণ ভয়ে তাঁকে ভোট দিয়েছেন? এ রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের সমাজে অনেকেই জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকেন। নূর হোসেনও হয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ নিশ্চয়ই সাত-সাতটি খুনের বিনিময়ে উপলব্ধি করছেন, নেতা ও প্রতিনিধি নির্বাচনে ভুল হলে তার খেসারত জনগণকে দিতে হয়। কেবল সিদ্ধিরগঞ্জ কেন, সারা বাংলাদেশই বারবার এই খেসারত দিয়ে যাচ্ছে। আমরা যে রকম নেতৃত্বের যোগ্য, সে রকম নেতৃত্বই বেছে নিই।
জনগণ যখন ভোট দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনে, তখন বিএনপি নূর হোসেনদের (সাতাশির অন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন নন) আশ্রয় দেয়। যখন তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে, তখন আওয়ামী লীগ তাঁদের দুধকলা দিয়ে পোষে। দুই-আড়াই দশক ধরে এ ধারাই চলে আসছে। ভোট ও গণতন্ত্র এক আশ্চর্য জাদুর কাঠি, যাতে ভালো মানুষ মাস্তান হয়ে যায়, গণতান্ত্রিক দল স্বৈরাচারী শাসকে রূপ নেয়। এই রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না, কিন্তু মাস্তান-সন্ত্রাসীদের বড় দোসর হয়ে ওঠে। সারা দেশেই হয়তো কমবেশি এ চিত্র।
বিএনপির শাসনামলে এই নারায়ণগঞ্জে অনেক মাস্তান তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন সরকার যে কয়েকটি এলাকার অপরাধ দমন করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ একটি। যার কারণে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব তৈরি করতে হয়। সেই র‌্যাবের নামেও এখন নানা অভিযোগ, তাদের নিয়ে জনমনে আতঙ্ক। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, এখানে পদায়িত র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় মাস্তানদের একটি অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছিল, যার ফলে একের পর এক খুন ও অপহরণ হচ্ছে।
আবার র‌্যাব সবটাই খারাপ করছে বলা যাবে না, তারাই নারায়ণগঞ্জে প্রভাবশালী পরিবারের টর্চার সেল উদ্ধার করেছে। তারাই ত্বকী হত্যার মামলা তদন্ত করে ১১ জনকে আসামি করেছে, যাদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ত্বকী হত্যা মামলার চার্জশিট আটকে গেছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, যে আসামি ত্বকী হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে, তারা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বিদেশে চলে গেছে।
ইতিমধ্যে সাত খুনের অভিযুক্ত নূর হোসেন ও ইয়াসিন সম্পর্কেও একই অভিযোগ শোনা যায়। কেউ বলেন দেশে আছেন, কেউ বলেন সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন। আবার স্থলপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়াও অসম্ভব নয়। ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন ভারত বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া এসব মাস্তান-খুনিদের আশ্রয় দিতেও দ্বিধা করছে না। শুনেছি, বাংলাদেশি পলাতক সন্ত্রাসীরা সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। কারও কারও স্থায়ী বাড়ি-ঘরও আছে। এখানে বিপদ দেখলেই ওখানে পালিয়ে যায়।
সাত খুনের লাশ বুকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাটি আজ নির্বাক, স্তব্ধ। বৃক্ষের পাতা বিবর্ণ। স্বজনদের কান্নার ভার ও দীর্ঘশ্বাস বইতে পারছে না বাতাস। কিন্তু সরকারের আচরণে, মন্ত্রী-নেতাদের বক্তৃতায় সেই শোকের বা বেদনার ছাপ নেই।
তাই মনে হয়, এবার নারায়ণগঞ্জবাসীর সব হত্যা, গুম ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নতুন করে জেগে ওঠার সময় হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারা জীবন কাব্যনাটকের সংলাপ ধার করে বলতে চাই, জাগো বাহে কোনঠে নারায়ণগঞ্জবাসী।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.