গোষ্ঠীগত বিভাজন বাড়ছে কেন by মুহাম্মদ আমির রানা

পাকিস্তানে গোত্রীয় বা গোষ্ঠীগত বিভাজন ক্রমেই বাড়ছে এবং প্রবল হচ্ছে। এটা শুধু মানুষের আচরণ ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে না, দেশটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভূমিও এর ফলে বদলে যাচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক ছাড়াও এই ক্রমবর্ধমান বিভাজনের কারণে পাকিস্তানে চরমপন্থী প্রবণতা সহিংস রূপ ধারণ করেছে। পাকিস্তানে সাম্প্রতিক কালে গোত্রীয় ও মতবাদভিত্তিক সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে। এর একটা বড় কারণ নানা উপদলীয় গোষ্ঠীর উত্থান এবং তাদের ক্ষমতায়ন। এই গোষ্ঠীগুলো শুধু দেশটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধরনটাকেই বদলে দিচ্ছে না, তারা জাতীয়তাবাদী ও আবহমান ভারতবিরোধী মনোভাবকে ধর্মীয় ও গোত্রীয় মোড়কে মুড়ে দিচ্ছে। প্রাত্যহিক জীবনে গোত্রীয় বিভাজন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ধর্মভিত্তিক জীবনযাপনও বাড়ছে। নানা গোত্র ও উপদলীয় গোষ্ঠী পৃথক আবাসন ও জনপদ প্রতিষ্ঠার জন্য উসকানি দিচ্ছে।

গোত্রীয় সহিংসতা পাকিস্তানে মূলত তিনটি রূপে আত্মপ্রকাশ করছে: ধর্মসংক্রান্ত সহিংসতা, সম্প্রদায় ও আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সহিংসতা এবং অনিয়মিত ও তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট সহিংসতা। ধর্মসংক্রান্ত সহিংসতা পাকিস্তানে সংগঠিত ও কাঠামোগত রূপ লাভ করেছে, বাকি দুটি সেই অর্থে কাঠামোগত নয়। এগুলো ঘটে সাধারণত ঘৃণা প্রকাশ ও ক্রমবর্ধমান গোত্রীয় অসহিষ্ণুতা, বিভিন্ন গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের স্বার্থের সংঘাত থেকে। প্রতিটি রূপই একে অপরের পরিপূরক।
কোনো ঘটনায় যদি একটির ছিপি খুলে যায়, তাহলে অন্য দুটিও ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় ধরনের গোত্রীয় সহিংসতা শুরু হলে এর প্রভাব সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়, এতে অন্য দুটি প্রকারের সহিংসতাও শুরু হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কুররম এলাকায় সংঘটিত আদিবাসী উপদলীয় উত্তেজনা প্রশমিত হতে প্রায় চার বছর সময় লেগে গেছে।
কোনো গোত্রীয় বিভাজনসংক্রান্ত ঘটনা ঘটলে, এর ফলে অন্য ধর্মের উপাসনালয় ও গোত্রীয় প্রতীকের ওপর হামলা হতে পারে। রাওয়ালপিন্ডিতে গত বছর এ ঘটনা ঘটেছে, মহররমের মিছিলে সহিংসতা শুরু হলে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানে উপগোষ্ঠীগত সহিংসতা কোনো নতুন বিষয় না হলেও ছোট ছোট বিভিন্ন গোষ্ঠী এখন ক্রমেই সংকীর্ণ গোষ্ঠী-প্রবণতা উসকে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সিন্ধু প্রদেশের খয়েরপুর জেলায় ১৯৬৩ সালে প্রথম বড় ধরনের শিয়াবিরোধী দাঙ্গা হয়েছিল, কিন্তু সরকার ও গোত্রীয় নেতারা আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান করেছিলেন।
একইভাবে ১৯৭০ সালে বিচ্ছিন্ন কিছু উপদলীয় ঘটনার ওপর ভিত্তি করে দেশব্যাপী একটি পোস্টার প্রচারণা শুরু হয়েছিল। স্লোগান ছিল, ‘সুন্নিরা জেগে ওঠো, পাকিস্তান তোমাদের’ (জাগো সুন্নি জাগো, পাকিস্তান তেরে হ্যায়)। তবে এটা জনগণ তো বটেই, বড় সুন্নি দলগুলোরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ হচ্ছে, তখন দেশে উগ্র গোষ্ঠীগুলো জাতীয় পরিসরে পাত্তা পেত না। কিন্তু করাচিতে ১৯৮৩ সালে যে উপগোষ্ঠীগত উত্তেজনা শুরু হয়, পুলিশের পক্ষে তা থামানো কঠিন হয়ে ওঠে। সে সময় উপসম্প্রদায়গুলো তাদের নিজ নিজ গোষ্ঠী-পরিচয় সম্বন্ধে শুধু সচেতন হতেই শুরু করেনি, তারা জাতীয় পরিসরে
ক্রমেই নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়েরাও তখন মাঠে নেমে গেছেন। ১৯৮৩ সালে করাচির গোত্রীয় সহিংসতায় মাওলানা সমিউল্লাহ ও মাওলানা আসফানদায়ারের নেতৃত্বাধীন দেওবন্দি সাওয়াদ-ই-আজম-আহল-ই-সুন্নাত ইরাকের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে শিয়াবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তবে এই আন্দোলন পাঞ্জাবের ঝংয়ে সিপাহ-ই-সাহাবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে ঢাকা পড়ে যায়। তারপর অন্য গোত্রগুলোও সংগঠন গড়ে তোলে। এর ফলে গোষ্ঠীগত উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এসবের সঙ্গে মাদ্রাসাগুলোও গোষ্ঠীগত বিভাজন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন গোত্র ও মাদ্রাসা সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত আত্মপরিচয় সৃষ্টির প্রয়াস চালায়।
গোত্রীয় নেতারা দাবি করেন, সন্ত্রাসবাদ ও ঘৃণা ছড়ানোর সঙ্গে মাদ্রাসাগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দাবি করে, মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর যোগাযোগ আছে। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গোত্র ও তাদের সহযোগী মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে, রাষ্ট্র ও সমাজ এই সহিংস সকীর্ণ গোষ্ঠীগত প্রবণতার সমস্যা দূর করতে উদ্যোগ নিতে পারে। পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গত বিভাজন সত্ত্বেও অধিকাংশ গোত্রীয় নেতা গোত্রগুলোর ঐকতান ও সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। ১৯৯০-এর শেষের দিকে তাঁরা জাতীয় ঐক্য কাউন্সিল গঠন করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা সব গোষ্ঠী-সম্প্রদায়কে এক সূত্রে আনেন। পাকিস্তানের গোত্রীয় প্রবর্তক মাওলানাদের বড় ভূমিকা আছে, জনণের ওপরও তাঁদের প্রভাব আছে। তাই ধর্মীয় গোত্রগুলোর মধ্যে ঐকতান সৃষ্টি ও তাদের মধ্যকার সহাবস্থানের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে তাঁদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
আরেকটি গুরুতর বিষয় হচ্ছে বিদেশি প্রভাব। বিভিন্ন ছোট ছোট গোষ্ঠীর নেতারা আরব দুনিয়ায় যা ঘটছে, তা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেন না। আরবের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাঁরা সংযুক্ত এবং তাঁরা পাকিস্তানে সেসব দেশের স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেন। সন্দেহ নেই, স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মুসলিম বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান রাষ্ট্র নিতে পারে।
পাকিস্তানের দৈনিক ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

মুহাম্মদ আমির রানা: পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.