রানা প্লাজাধসের এক বছর- ‘পা তো দ্যাশে পাঠাইয়া দিছি’ by মানসুরা হোসাইন

রেহানা বলেন, ‘আমার পা তো দ্যাশে পাঠাইয়া দিছি। পায়ের অনেক ওজন। লুজও (ঢিলা) হইয়া গেছে। একটু হাঁটলেই মনে হয় পা খুইল্যা পইড়া যাইবো। পা কাজে লাগে না। এখন আমার হুইল চেয়ারই ভরসা।’ রানা প্লাজার ধসে আহত রেহানার বাবা নেই। মা আর ছোট দুই ভাই আছে। এক ভাই পড়াশোনা করছে, অন্য ভাই বেকার। রেহানা বর্তমানে সিআরপিতে আছেন।

রেহানা বলেন, ‘যখন থাইল্যান্ডের দল পা লাগাইয়া হাঁটবার কয়, তখন জোর কইরাই হাঁটছিলাম। কিন্তু পাঁচ মিনিট হাঁটার পরই অস্থির হইয়্যা যাই। শক্তি লাগে অনেক। পায়ের ভেতরে ব্যথাও করে।’
শুধু রেহানা নন, থাইল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞ দল এসে রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের কৃত্রিম পা লাগিয়ে হাঁটার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। কেউ কৃত্রিম পা দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, কেউ তা সাজিয়ে রেখেছেন। কেউ আবার ভবিষ্যতে এই পা দিয়েই হাঁটতে পারবেন বলে নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ড সরকারের বিশেষজ্ঞ দলের সহায়তায় আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত) আহত শ্রমিক এবং বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ৯৮ জনের বিনা মূল্যে কৃত্রিম পা লাগানো হয়। এর মধ্যে রানা প্লাজার ১২ জন শ্রমিকের তালিকা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সাতজনের পা লাগানো হয়। পঙ্গু হাসপাতালে মোবাইল নম্বর আছে পাঁচ জন শ্রমিকের। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চারজনের সঙ্গে কথা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাইল্যান্ড সফরে গিয়ে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কাছে রানা প্লাজার আহত ব্যক্তিদের কৃত্রিম পা লাগানোর কাজে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানান। পরে থাইল্যান্ড থেকে ৬০ সদস্যের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। পা লাগিয়ে দিয়ে বিশেষজ্ঞ দল চলে যায়।
শ্রমিকদের অভিযোগ, সরকারের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে পা দিয়েই খালাস। শ্রমিকেরা হাঁটতে পারছেন কি না তা আর কেউ খোঁজ নেয়নি। পঙ্গু হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, কৃত্রিম পা লাগানোর আগে বেশ কয়েক দিন সময় নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। পা ফোলা বা ঘাঁ থাকলে তা শুকাতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অনুশীলন শেষ করে যার যার পা দিয়ে দেওয়া হয়। থাইল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ দল যেসব যন্ত্রপাতি এনেছিলেন তা আবার নিয়ে চলে গেছেন।
পঙ্গু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক (কৃত্রিম হাত-পা তৈরি বিভাগ) মোজাহার মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজার তিনজনসহ মোট ১২ জন কৃত্রিম পা ব্যবহার করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। সবার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পরে তা পরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হবে।
সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রতিবেদকের সামনেই রানা প্লাজার আরেক আহত শ্রমিক শিল্পীকে সাহস দিচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞ দল। সিআরপিতে থাকা শিল্পীও তাঁর কৃত্রিম পা সাভারের বাসায় রেখে এসেছেন। সিআরপি থেকে আরেকটি কৃত্রিম পা দিয়েছে, লাঠির সাহায্যে তাই দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছেন তিনি।
আহত শ্রমিক আরেক রেহানারও হাঁটুর ওপর থেকে এক পা কাটা। সিআরপিতে প্রশিক্ষণরত এই রেহানাও কৃত্রিম পা দিয়ে হাঁটতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে রেহানা যে টাকা পেয়েছেন স্বামী সে টাকার ভাগ চান। টাকা না দেওয়ায় রেহানা এবং তাঁর তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া সন্তানকে ফেলে চলে গেছেন।
গাইবান্ধার জুয়েলের বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। ডান পায়ে অস্ত্রোপচারের সময় তিনটি রগ কেটে গেছে। পায়ে তিনি আর শক্তি পান না। জুয়েল বলেন, ‘যখন মাপ দিয়া পা বানায় তখন ঠিক ছিল। পরে আবার অপারেশন কইরা বাম পা থেইক্যা দুই ইঞ্চি বাদ দিতে হইছে। ফলে এখন কৃত্রিম পা’টা বড় হইয়্যা গেছে।’ জুয়েল এখন স্ত্রী ও দুই বাচ্চাসহ সিআরপিতে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর পায়ের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা শেষে কৃত্রিম পা দিয়ে আবার হাঁটার চেষ্টা করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক চিকিৎসক জুলফিকার লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, কৃত্রিম পা ব্যবহারের জন্য অনেক অনুশীলন প্রয়োজন। ব্যবহারের জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিও থাকতে হবে। রানা প্লাজার শ্রমিকদের ব্র্যাকের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি কেন্দ্র, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। শ্রমিকদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে ফলোআপ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.