‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’ সিনড্রোম by আবদুল মান্নান

২০০০ সালের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের চতুর্থ বর্ষ চলছে। চিন্তা করছি, চ্যান্সেলরকে বলে পদ থেকে ইস্তফা দেব। কারণ, ইতিমধ্যে আমার দু-একজন নিকটজন চ্যান্সেলরের কাছে চিঠিপত্র দিয়েছেন এই বলে যে আমার মতো অযোগ্য উপাচার্য আর হয় না। সুতরাং, আমাকে সরিয়ে যেন তাঁদের পছন্দমতো আরেকজনকে উপাচার্য করা হয়। কারণ, আমি তাঁদের কথামতো নিয়মনীতি ভঙ্গ করে চলতে অস্বীকার করেছি। পরবর্তীকালে সেসব চিঠির কিছু কপি আমার হাতে এসেছিল এবং সেগুলোর আবেদনের ভাষা দেখে আমি অবাকও হয়েছিলাম।

আমার এক প্রাক্তন ছাত্র, যে কিনা দীর্ঘদিন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে, তাকে আমার অভিপ্রায়ের কথা জানালাম। আমার ছাত্র তার উপাচার্যকে জানাল, আমাকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন কি না। উপাচার্যের সোজাসাপটা উত্তর, ‘উনি তো খুব বেশি পলিটিক্যাল। তাঁকে নেওয়া যাবে না।’ বুঝলাম না কেমন করে আমি এত বেশি পলিটিক্যাল হলাম।

২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আমি আর উপাচার্যের পদে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের আহ্বানে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলাম। চারদলীয় জোট সরকার তখন ক্ষমতায়। আমার একমাত্র সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়েই এমএসএস পাস করেছে। বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করল। পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্ত আর তার প্রবেশপত্র এল না। তার ধারণা, আমি ‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’ বলে তার প্রবেশপত্র আসেনি। পরেরবার সে নিজে গিয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়ে আসে। ফলাফল আগের মতোই। এবার আমার বিশ্বাস হলো, নিশ্চয়ই আমি ‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’ না হলে দুই-দুবার কেন আমার মেয়ের প্রবেশপত্র আসবে না? আমার আগের কর্মক্ষেত্রে প্রভাষক পদে শিক্ষক নিয়োগ দেবে। মেয়ে আবেদন করল। বিভাগটি আমি উপাচার্যের দায়িত্বে থাকাকালে দেনদরবার করে আর চারটি বিভাগের সঙ্গে খুলে দিয়েছিলাম। চিন্তা করলাম, মেয়ের চাকরিটা হবে। ইতিমধ্যে একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দুই বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হয়েছে। না, এবারও হলো না। কারণ, একটি ছাত্রসংগঠন উপাচার্যকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আমার মেয়েকে নিয়োগ দিলে তাঁর খবর আছে। বুঝলাম, মেয়ে বেচারা আমার ‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’ হওয়ার খেসারত দিচ্ছে। তখন নিজেকে অনেকটা অপরাধীই মনে হচ্ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মীকে সেদিন বলছিলাম, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তিন দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করেছি, উপাচার্য ছিলাম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি বিধিবদ্ধ পর্ষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলাম, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো আমি প্রভাষক পদের নিয়োগ বোর্ডে সিন্ডিকেট মনোনীত সদস্য ছিলাম না। কারণ ওই একই; আমি ‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’। সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা দুবার জানতে চাইল, তারা আমন্ত্রণ জানালে আমি তাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দু-একটা বক্তব্য দিতে রাজি কি না। বললাম, কেন নয়? তারা জানাল, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে ক্লিয়ারেন্স লাগবে। বলি, অসুবিধা নেই। কিন্তু সেই অনুমতি আর পাওয়া যায়নি। একবার চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আর দ্বিতীয়বার মহাজোট সরকারের আমলে। কারণ সম্ভবত একই; ‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’।
আমার মেয়ে একটি ছোট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য উচ্চতর পদে আবেদন করল। বাছাইপর্বেই বাদ। ওই বিভাগের একজন বন্ধু সহকর্মীর কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘ভাই, মেয়ের প্রকাশিতব্য লেখাটি প্রকাশিত হোক, তখন তার আবেদন বিবেচনা করা যাবে।’ তখন বলি, একজনের আবেদন তো বিবেচনা করা হয়েছে, যিনি শুধু একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। এ বিষয়ে বন্ধু একেবারে লা-জওয়াব। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওই প্রার্থীর স্বামী ওই বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সুতরাং, তাঁকে চাকরিতে না নিলে বেজায় অন্যায় হবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মেয়ে আগেও একবার আবেদন করেছিল। না, সেবারও তার নিয়োগ হয়নি। যাকে নেওয়া হয়েছিল, তার ফলাফল কোনো রকমে দ্বিতীয় শ্রেণী। একটি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করেছিল। সেই স্কলারশিপ বহুদিন ধরে অনেক মধ্যমেধার পড়ুয়ারা পাচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগে যে রাজনীতি এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার বেহাল দশা চলছে, ওপরের উদাহরণগুলো তার সামান্য চিত্র মাত্র।
আমার দুজন সাবেক সহকর্মী নতুন প্রতিষ্ঠিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। থাকতে পারেননি বেশি দিন, কারণ স্থানীয় সাংসদ আর রাজনীতিবিদদের দৌরাত্ম্য। পিয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ অথবা পদোন্নতি—এমন জায়গা নেই, যেখানে তাঁরা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন না। তাঁদের কথা না শুনলে উপাচার্যের জন্য বড় বিপদ। উপাচার্য রাজনীতিবিদ বা স্থানীয় সাংসদের বশংবদ হবেন না, তা কি হয়? সেই দুই উপাচার্য এখন চাকরি ছেড়ে বিদেশে। ভালোই আছেন।
আর দেশে ক্ষমতার পালাবদল হলে পাল্টে যায় ‘সৈনিকের’ ইউনিফর্ম। সাফারি কোটের জায়গায় মুজিব কোট। চটজলদি মুজিব সৈনিক বা জিয়ার সৈনিক বনে যাওয়াদের উৎপাতে উপাচার্যদের নাভিশ্বাস। ভাগ্য ভালো, আমাদের মেয়াদকালে কখনো কোনো সাংসদ কোনো একজন ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়ার জন্য কোনো তদবির করেননি। আবার শিক্ষক নিয়োগের বেলায় কোনো কোনো বিভাগে আছে একধরনের গোত্রীয় সংস্কৃতি। কিছু বিভাগ আছে, ছাত্র থাকা অবস্থায় কোনো একজন শিক্ষক হয়তো তাঁর কোনো একটি প্রজেক্ট বা তাঁর পরিচালিত একটি এনজিওতে তাঁর ছাত্র বা ছাত্রীটিকে বেগার খাটান এই নিশ্চয়তায় যে পাস করলে তাঁর চাকরি হবে। যোগ্যতা থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক সময় যোগ্যতা ছাড়াও অনেকে বিভাগের শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। এই সংস্কৃতি আগেও ছিল, তবে বর্তমানে ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জবাবদিহির অভাব প্রচণ্ড। দিনের পর দিন ক্লাস না নিলেও কারও জবাবদিহি নেই। ক্ষতি শিক্ষার্থীদের। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা। আর নিয়োগের সময় ‘অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল’ সিনড্রোম বাদ না দিলে সব সময় উপযুক্ত প্রার্থী কি পাওয়া যাবে?
এ তো গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও যে এর চেয়ে ভালো, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের পদ্ধতি বেশ ভালো এবং চেষ্টা করা হয় ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে। তবে দেশের প্রায় ৬০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা বলা যাবে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয় সস্তায় শিক্ষক খোঁজে; বাদাম ছিটিয়ে বানর আকৃষ্ট করার মতো। একজন শিক্ষককে সেখানে সপ্তাহে ২০ থেকে ২৪টি ক্লাস নিতে হয়, এতে শিক্ষকেরা নিজের জ্ঞানোন্নয়নে কোনো নজর দিতে পারেন না। ফলে তাঁর ক্লাসে পাঠদান নিম্নমানের হতে বাধ্য। অনেকের ধারণা, সরকারি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে বুঝি আকাশ-পাতাল তফাত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তা মোটেও নয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে অনেক সময় আক্কেলগুড়ুম হতে হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল? চটজলদি জবাব, ‘ভাষার জন্য’। একজন কূটনীতিবিদ হতে চায়। বলে, হেনরি কিসিঞ্জারের নাম শোনেনি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছে। একটি দামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট বেশ সদর্পে ঘোষণা করল, সে কখনো গল্পের বই পড়েনি। বাংলাদেশের কোন শহরকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলে? সেটা আবার কী? এসব অজ্ঞতার দায়-দায়িত্ব তো প্রাথমিকভাবে শিক্ষকদের নিতে হবে। শিক্ষক যদি না জানান, তাহলে ছাত্ররা কোথা থেকে জানবে?
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে আনুমানিক পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের আধা পয়সা খরচ নেই। উল্টো প্রায় ১৬ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। শিক্ষকদের দিতে হয় সরকারি নিয়মে আয়কর। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের, তথা জনগণের বিশাল অর্থ ব্যয় হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে গড়ে ৬০ হাজার টাকা ব্যয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কোনো ব্যবস্থা থেকেই তেমন প্রত্যাশিত ফল আসছে না। কেন আসছে না, তার উত্তর বহুবিধ। প্রথমে যোগ্য ব্যক্তিরা এখন আর শিক্ষকতায় আসছেন না, অথবা আসতে দেওয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, যে শিক্ষার্থীর যে বিষয়ে পড়া উচিত নয়, সে সেটা পড়ছে। এর ফলে ভয়াবহভাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এটি একটি জাতীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত দেশ বেশি দিন বইতে পারবে না। এ বিষয়ে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। এ কাজ করতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে। দুটি সংস্থাকেই দুজন যোগ্য ব্যক্তি নেতৃত্ব দেন। এই মুহূর্তে তাঁদের ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। শুরুটা হোক না গোত্র-সংস্কৃতি ভাঙার মাধ্যমে।

আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.