মহানক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ by আলী আহমদ

বছর দুই-তিনেক আগেই সম্ভবত আমাদের কোনো একটি দৈনিকের ভেতরের পাতার ছোট্ট একটি সংবাদে চোখ আটকে গিয়েছিল এখনও সুস্পষ্ট মনে আছে। সংবাদটি ছিল গার্সিয়া মার্কেসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে। ততদিনে বয়স তার চুরাশি-পঁচাশি হয়ে গিয়েছিল। আর সিগারেট টানতেন তিনি ভয়ানক রকমের বেশি। সুতরাং তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া দুঃখজনক হলেও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এবং তার অল্প কিছুকাল পর খবরের কাগজের মাধ্যমেই আবার জেনেছিলাম, তিনি আর লেখালেখি করবেন না ঘোষণা দিয়েছেন। কোনো আপনজনের চিরবিদায় আসন্ন বুঝতে পারলে বুকের মধ্যে চাপা একটা ব্যাথা যেমন হাজারো কাজের মধ্যে থেকে-থেকেই মোচড় দিয়ে ওঠে, সত্যি বলতে কি, তেমনি একটা ব্যাথা যেন অনুভব করতাম গার্সিয়া মার্কেসের এ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং তার আসন্ন চিরবিদায়ের অবশ্যম্ভাব্যতায়। সুতরাং ১৭ এপ্রিল, ২০১৪, তারিখে তার মারা যাওয়ায় এবং তারও দিন কয়েক আগে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আর সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা আমার কাছে এক ধরনের যান্ত্রিক নিরর্থকতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। আমরা যেন এক ধরনের জেনেই গিয়েছিলাম তিনি চলে যাচ্ছেন চিরকালের জন্য।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এই চলে যাওয়া সাধারণ কোনো লেখকের চলে যাওয়া নয়, এমনকি প্রচলিত অর্থে অসাধারণ কোনো লেখকেরও চলে যাওয়া নয়; এ হচ্ছে সাহিত্যের এক যুগ-প্রবর্তকের মহাপ্রয়াণ, একথা অন্তরের গভীরে অনুধাবন করবেন বিশ্ব সাহিত্যের যে-কোনো মননশীল পাঠক। গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮২ সনে, পঞ্চান্ন বছর বয়সে। সাহিত্যের এ পুরস্কার কোনো লেখক বা কবির সার্বিক সাহিত্যকর্মের জন্য দেয়া হলেও, সংশ্লিষ্ট লেখক বা কবির দু-একটি বই তার শ্রেষ্ঠ রচনা বলে পাঠক-সমালোচক মহলে পরিচিতি লাভ করে। গার্সিয়া মার্কেসের ওই শ্রেণীর একাধিক বই থাকলেও, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তার জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাস সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ বা শতবর্ষের নির্জনতা এমনই একটি পরিচিতি বা খ্যাতি লাভ করেছে। বইটি এমনিতে খুব যে সহজবোধ্য তা বলা যাবে না; তবুও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে এখনও পর্যন্ত বইখানির তিন কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পুরো পৃথিবীতে শুধু বাইবেলই এর চেয়ে কিছুটা বেশি বিক্রি হয়েছে বলা হয়ে থাকে। যে-কোনো সাহিত্যস ষ্টার জন্য এ সম্মান শুধু বিরল নয়, অনন্য। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেসের খ্যাতি শুধু একারণেই নয়; কিংবা, বলা চলে, মোটেই এ কারণে নয়।
সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিকে মোটেই খাটো করে না-দেখেও বলা চলে যে ১৯০১ সালে এ পুরস্কার প্রবর্তণের পর থেকে মহাযুদ্ধের দুএক বছর বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত এ পুরস্কার একশ দশজনের বেশি লেখক-কবিকে দেয়া হয়েছে। ওইসব লেখক-কবিদের অধিকাংশ তাদের নিজ নিজ দেশ এবং/কিংবা ভাষিক অঞ্চলে অবশ্যই পঠিত ও সম্মানিত হন বলে ধরে নেয়া যায়; কিন্তু বৈশ্বিক সাহিত্যমহলে তাদের কতজন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমীহ ও ভালোবাসা পান এবং তাদের সাহিত্যকর্ম পঠিত হয় কিংবা তাদের ব্যাপক চর্চা হয় তা প্রায় যে-কেউ অনুমান করতে পারেন। অথচ নোবেল পুরস্কার শুরুর পর ওই পুরস্কার পাননি এমন অনেকেই কিন্তু এ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বসাহিত্য সভায় আপন গৌরবে দীপ্ত হয়ে আছেন। লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভ, হোর্হে লুইস বোর্হেস... এদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন। কারও নামোল্লেখ করে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত কাউকে আমরা ছোট করার চেষ্টা করে না বলেই নাম-না-করে বলছি যেসব পৃথিবী তো দূরের কথা, নোবেল পাওয়া অনেক লেখক তাদের নিজ দেশে, নিজ ভাষায় শুধুই একটি রেকর্ড হয়ে আছেন; পাঠকের মনে নেই, এমনকি কাছেও হয়তো নেই। সুতরাং নোবেল পুরস্কার গার্সিয়া মার্কেসকে এমন খ্যাতিমান করে তোলেনি।
যে-কোনো মানোত্তীর্ণ শিল্পী নিঃসন্দেহে অসাধারণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখেন, এবং যে-কোনো শিল্পমাধ্যমের কথা আলোচনায় আনলে, এমনকি ইতিহাসের নিরিখে আলোচনা করলে, একগাদা না-হলেও বেশ কয়েকজনের নাম প্রায় এক নিঃশ্বাসে উঠে আসে। একথা চিত্রশিল্পের বেলায় যেমন, সাহিত্যের বেলায়ও তেমনভাবেই প্রযোজ্য। কিন্তু যুগে যুগে কিছু কিছু শিল্পস ষ্টার আবির্ভাব ঘটে যারা অন্যতম নন, একেবারেই অনন্য। তারা নতুন যুগের সূচনা করেন, তারাই যুগপ্রবর্তক। চিত্রশিল্পে একনামে যেমন বলা যায় পাবলো পিকাসোর কথা, সাহিত্যে তেমন একইভাবে উল্লেখ করা যায় গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নাম। চিত্রশিল্পে পিকাসো যেমন, কথাসাহিত্যে গার্সিয়া মার্কেস তেমন... সম্পূর্ণ নতুন একটি দুনিয়া খুলে দিয়েছেন আমাদের চোখের সামনে। এদের প্রত্যেকেরই শিষ্য-ভাবশিষ্য এবং মেধাবী অনুসারি তৈরি হয়েছে জগৎব্যাপী, এবং ভবিষ্যতে আরও হবে ধরে নেয়া যায়।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে গার্সিয়া মার্কেস যখন সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু গল্প লেখা শুরু করেন সেগুলো পড়ে স্পেনীয় সাহিত্যের পাঠকেরা বেশ খানিকটা চমকে উঠেছিলেন অনুমান করা যায়। কারণ তখনকার লাতিন আমেরিকার তো নয়ই, স্পেনেরও নয়, এমনকি সুপরিচিত ইংরেজি-ফরাসি-জর্মানি কিংবা অন্য কোনো সাহিত্যে অমন ধরনের গল্প কেউ কখনও পড়েছে কিংবা দেখেছে বলে মনে করতে পারেনি। কেমন এক অস্পষ্ট, ধোঁয়াশা-ধোঁয়াশা অনচ্ছ এক আবরণের এপার থেকে দেখা যেন কোনো ঘটনা; যেনবা পুরু অথচ স্বচ্ছ এক কাচের এপার থেকে ওপারে দেখা ঘটমান কোনো বিষয়; এ বিষয়ে প্রেম আছে, যুদ্ধ আছে, ঔপনিবেশিকীকরণ আছে, আছে তার অমানবিক শোষণ, আর আছে ইউরোপ থেকে পূর্বপুরুষের বয়ে-আনা ইতিহাস, কল্পকথা, রাগ-বিরাগ আর তার সঙ্গে মিশেল-দেয়া স্থানীয় লোককাহিনী। মোদ্দাকথায়, এই হচ্ছে গার্সিয়া মার্কেসের জাদুবাস্তবতাধর্মী বর্ণনারীতি। সাহিত্যের অনুধাবকেরা স্বীকার করবেন আশা করি যে, সাহিত্য স্বভাবতই কিছুটা নেশাধর্মী; তার সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেসের এ জাদুবাস্তবতার মিশেল যেনবা উঁচু জাতের একাধিক পানীয়ের এক ককটেল। সারা পৃথিবী তাকে লুফে নিল। তিনি হয়ে উঠলেন একেবারে অনন্যসাধারণ এক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এত গেল তার আখ্যান বর্ণনারীতি। তার সাহিত্যের বহিরাঙ্গন। তার সাহিত্যের শাঁস, বর্ণনার বিষয়বস্তু, তো পরিচিত হয়েও একেবারে যেন আনকোরা; নতুন বইয়ের পৃষ্ঠা শুঁকতে নাম-না-জানা কেমন একটা ভালোলাগা যেমন মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি মাদকতা মাখানো তীব্র ঝাঁঝালো এক স্বাদ তার লেখার মধ্য থেকে উঠে এসে কখন যেন নিজের অজান্তে পাঠককে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সারা পৃথিবীর অনেক বড় বড় লেখকদের অনেক বই পড়েছি তাদের অনেককে একান্ত আপনার করে ভালোবাসি। তবুও বলব গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সবার থেকে আলাদা, অনন্যসাধারণ।
মাকে তিনি ভালো করে চিনেছিলেন বেশ খানিকটা বড় হওয়ার পর। পুরো বাল্যকাল আর কৈশোরেরও বেশ বড় একটি অংশ কেটেছে তার দাদির কাছে। সেই দাদি, অনুমান করা চলে, তুখোড় এবং আকর্ষণীয় এক গল্প-বলিয়ে ছিলেন। কারণ গার্সিয়া মার্কেস পরবর্তীকালে বলেছেন যে, ওই দাদির কাছে তিনি যে-সব গল্প আর কল্পকাহিনী শুনেছিলেন ছোটবেলায় তা-ই লিখেছেন তিনি তার গল্প-উপন্যাসে।
বিষয়টি যতটা সোজা-সাপটা করে বুঝানোর চেষ্টা তিনি করেছেন ততটা সহজে কিন্তু আমরা নিতে পারি না। গল্প-বলিয়ে দাদি-নানী কোনোটা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার অবশ্য হয়নি; কিন্তু যাদের হয়েছে বলে জানি তাদের একেকজন কেউ একেকটা গার্সিয়া মার্কেস হয়ে বসে নেই। আসলে গার্সিয়া মার্কেসের মনোজগতে সম্পূর্ণ নতুন গল্প-ভুবন তৈরির এক অফুরন্ত বারুদের স্তূপ জমা হয়েছিল তার দাদির গল্প শোনানো তাতে একটি দেশলাইয়ের কাঠি মাত্র ছুঁইয়ে দিয়েছিল, তার বেশি কিছু নয়।
পুরো পৃথিবীর ধ্র“পদী সাহিত্যস ষ্টাদের কথা বাদ দিলে, আধুনিককালের লেখকদের মধ্যে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসই সম্ভবত বাংলাদেশ তথা সব বাংলাভাষী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পঠিত, পরিচিত ও আলোচিত। বিশ্বের খ্যাতনামা লেখকদের নিয়ে আলোচনা উঠলে প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের অনেকটা মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলতে হয় যে, তিনি আমাদের পাঠককুলের কাছে প্রায়-অপরিচিত। এ মহান লেখকের সম্পর্কে, সৌভাগ্যক্রমে, তেমন জোড়হাত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। পশ্চিম বাংলায় তার অনুবাদ আমাদের চেয়ে কিছুটা আগে শুরু হলেও, বাংলাদেশও তেমন একটা পিছিয়ে নেই। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, আমাদের (সম্ভবত পশ্চিম বঙ্গেরও) প্রকাশকরা যদি অনুবাদকদের সঙ্গে আর্থিক ও অন্যান্য বিষয়ে সৎ হতেন, তাহলে গার্সিয়া মার্কেসসহ বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য বড় বড় লেখকরা সক্ষম অনুবাদকদের হাত ধরে বাঙালি পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতেন, এবং বাংলা সাহিত্যও সহজবোধ্য কারণে সমৃদ্ধতর হতো। প্রকাশকদের সবাই হয়তো অসৎ নন; কিন্তু তা হয়তো ব্যতিক্রমই, বাস্তব অবস্থানের নির্ণায়ক নয়। পশিমবঙ্গের মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গার্সিয়া মার্কেসের একাধিক বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন; সেখানে আরও কেউ কেউ হয়তো তার অন্য কোনো কিছু অনুবাদ করে থাকতে পারেন। আমি দুঃখিত তাদের সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমাদের এখানে শতবর্ষের নির্জনতা অনুবাদ করেছেন জি, এইহ, হাবীব, প্রেম ও কলেরা অনুবাদ করেছেন কবীর চৌধুরী, মৃত্যুর কড়ানাড়া করেছেন বেলাল চৌধুরী, গোলকধাঁধায় সেনাপতি করেছেন মোরশেদুর রহমান, একটি অপহরণ সংবাদ করেছেন সুরেশরঞ্জন বসাক, গোত্রপিতার হেমন্ত করেহেন অদিতি ফাল্গুনী, আমার দুঃখভারাক্রান্ত বেশ্যাদের কাহিনী এবং বর্তমান লেখক করেছেন বারো অভিযাত্রীর কাহিনী ও প্রেম ও অন্যান্য দানব। সুতরাং নিদ্বির্ধায় বলা চলে যে মহান এ লেখকের প্রধান প্রধান বই সবগুলোই বাংলায় অনুদিত হয়ে আমাদের এখানে প্রকাশিত হয়েছে। এটি সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য অবশ্যই একটি ভালো খবর। উপর্যুক্ত প্রায় সবাই প্রথম শ্রেণীর; অনুবাদগুলোও আশা করি তাই ভালো হয়েছে। বাংলায় যারা গার্সিয়া মার্কেসের অসাধারণ সাহিত্যের স্বাদ পেতে চান তাদের জন্য এতই অবশ্যই একটি সুখবর।

No comments

Powered by Blogger.