রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্তিতে বিজিএমইএর স্মরণসভা- এমন মৃত্যু আর নয়

রানা প্লাজা ধসের মতো আর যেন ঘটনা না ঘটে। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্মকাণ্ডের জন্য আর কেউ যেন স্বজনহারা না হয়, সন্তানেরা যেন এতিম না হয়। এমন কথা বারবার ফিরে এল রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর স্মরণসভায়।

>>রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্তিতে গতকাল সকালে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠনগুলো রাজধানীতে বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে শোক র্যালি বের করে প্রথম আলো
বিজিএমইএ কার্যালয়ের মিলনায়তনে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত এই স্মরণসভায় সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক, নিহতদের সন্তান, উদ্ধারকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
স্মরণসভায় বিজিএমইএর উদ্যোগে ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের ওরকা হোমসে বিভিন্ন শ্রেণীতে অধ্যয়নরত নিহত শ্রমিকের ১৪ ছেলে ও আঞ্জুমান আজিজুল ইসলাম এতিমখানায় থাকা নিহত শ্রমিকের ১৫ মেয়ে উপস্থিত হয়।
এদের মধ্যে এতিমখানায় থাকা আরিফা খাতুন বলে, ‘আমার মা রিনা খাতুন রানা প্লাজার চারতলার কারখানায় হেলপারের কাজ করতেন। মা-ই সংসার চালাতেন। বাবার হাঁপানি। ভবনধসে মা মারা যাওয়ার পর আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। এর পরই বিজিএমইএ দায়িত্ব নেয়।’ আরিফা পড়ালেখা করে বড় কর্মকর্তা হতে চায়।
নিহত উদ্ধারকর্মী কায়কোবাদের বড় বোন নূরজাহান বলেন, ‘যে কারণে আমার ভাই আজ নেই, যারা এ ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের আমি কখনোই ক্ষমা করব না। দেশের আইনকানুনও যেন তাদের ক্ষমা না করে। ভাই হারিয়ে আমি যে কষ্ট পেয়েছি, যারা স্বজন হারিয়েছে, তারা কেবল সেটি বুঝবে...।’
এ ছাড়া রানা প্লাজা ধসে আহত নিলয় সর্দার, সাথি আক্তার, নিহত মো. ইসহাকের ছেলে মোস্তফা কামাল, আবু সাঈদের স্ত্রী মমতাজ বেগম, উদ্ধারকর্মী খোঁয়াজ আলী বক্তব্য দেন। তাঁদের বক্তব্য পুরো মিলনায়তন এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ভবনধসে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতার মধ্য দিয়ে স্মরণসভাটি শুরু হয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীন দেশে এমন ঘটনা দেখব বলে ভাবি নাই। আসুন, আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। আর যেন একটি কারখানায়ও দুর্ঘটনা না ঘটে। গত এক বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে। মালিকদের এখন উচিত সব নিয়মকানুন মেনে পোশাক কারখানা কমপ্লায়েন্ট করা।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে এখন দ্বিতীয় থেকে প্রথম হতে হবে। সে জন্য কারখানা আধুনিকায়ন করতে যেসব যন্ত্র লাগবে, সেগুলো শুল্কমুক্ত করা হবে।’ তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা শুধু মালিক নন, শ্রমিকেরাও মালিক। কারণ শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়েই মালিকেরা মুনাফা করেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে শপথ করছি ব্যবসায়ী, সরকারের মন্ত্রী কিংবা যত দিন এই পৃথিবীর বুকে শ্বাস নেব তত দিন এমন কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করব না যাতে করে একটি মানুষের প্রাণ যেতে পারে।’ তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসে পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পর্যায়ে গিয়েছিল। তাই এই ঘটনাকে যেন মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর দিন হিসেবে নেয়, সে রকম কাজ করতে হবে। সারা বিশ্ব যেন বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে দেখে।
মেট্রো চেম্বারের সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘আজ অনেক কষ্টের পাশাপাশি লজ্জা হচ্ছে। কেন এমন হলো?’ তিনি নিহত ও আহত সবার জন্য দোয়া কামনা করেন।
শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘সামান্য ভুলের জন্য আজ কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেসারত দিচ্ছে। যা-ই ক্ষতিপূরণ দেন, তাদের বাবা-মাকে তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা যেন দুর্নীতিগ্রস্ত না হন, তাঁদের এই জায়গা থেকে বের করতে হবে। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাও আর আমাদের নিয়ে খেলবেন না। মালিকদের বলব, অতিমুনাফার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসুন। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।’
ক্রেতাদের উদ্দেশে নাজমা আক্তার বলেন, ‘আপনারা পোশাকের ন্যায্য দাম দিন, ন্যায্য ব্যবসা করুন। এটা না করার কারণেই রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে।’
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম রানা প্লাজা ধসে উদ্ধারকাজের সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘যত দিন আহত শ্রমিক থাকবেন, তত দিন আমরা কাজ করব। আর যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে, যদি তাঁদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয় এবং শ্রমিকদের জীবনমান নিশ্চিত করা যায়।’
স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, শ্রমসচিব মিকাইল শিপার, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও সালাম মুর্শেদী, বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ প্রমুখ।
এর আগে বেলা সোয়া ১১টায় বিজিএমইএর কার্যালয়ের সামনে এক শোক র‌্যালির আয়োজন করে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ। এতে পোশাকমালিক, তিন সংগঠনের নেতা, বিদেশি ক্রেতা, অ্যাকর্ডের কর্মকর্তা ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। পরে বিজিএমইএ ভবনের নিচে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.