কেমন হলো উপজেলা নির্বাচন?

নানাবিধ অনিয়ম ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন। মোট ৪৫৮টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তবে বিভিন্ন কারণে আরও ২২টি উপজেলার নির্বাচন এখনো অসমাপ্ত। এটি ছিল চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি প্রায় ১৭ বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৃতীয় নির্বাচন। শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম প্রধান স্তর হতে পারে উপজেলা পরিষদ। বিগত প্রায় তিন দশকে উপজেলা পর্যায়ে বহু অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণেরও কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন নির্দলীয় হলেও সব দলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে যে সব দলই উপজেলাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মনে করছে। এটা এ দেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে বড় পদক্ষেপ। এই কারণে উপজেলা নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এবারের গুরুত্ব ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশের এবং ফলাফলের প্রেক্ষাপটে, যেখানে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি ও তার শরিকেরা এতে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচন কমিশন পাঁচ ধাপে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। এর কারণ, দুই জোটের বা দলের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনে কিছু কিছু অনিয়ম হলেও বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীদের অগ্রগামী থাকা চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয় সরকারি দল এবং সমর্থিত প্রার্থীদের। বস্তুত সেখান থেকেই শুরু হয় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা আর সার্বিক অনিয়ম। বাকি দুটি ধাপে সহিংসতা ও কেন্দ্র দখল করতে গিয়ে প্রাণহানি হয় ডজন খানেক ব্যক্তির।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। সমালোচনার মুখে পঞ্চম ধাপে কৌশল পরিবর্তন করতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া হয় নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করার প্রক্রিয়া এবং এতে যোগ দেন নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দৃশ্যত নির্বাচন ব্যবস্থাপক নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সমালোচনার মধ্যে নির্বাচন কমিশন স্বীকার করে, কোনো কোনো জায়গায় প্রশাসন অসহযোগিতা করেছে। তাদের এ ধরনের অভিযোগও অভূতপূর্ব। কারণ, প্রশাসন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া রয়েছে। এমনকি শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে কমিশনের এখতিয়ারে। আইনের আওতায় নির্বাচনকালের পরেও প্রায় দুই সপ্তাহ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের আওতায়ই থাকেন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ নয়, নির্বাচন কমিশন যাদের সহযোগিতা পায়নি, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধি প্রয়োগ করা উচিত ছিল। এ আইন সরাসরি নির্বাচন কমিশনকেই প্রয়োগ করতে হবে, কারও মাধ্যমে নয়। যেকোনো নির্বাচন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তিনটি উপাদান বিবেচনায় আনতে হয়। প্রথমত, কৌশল নির্ধারণের জন্য সার্বিক বিবেচনা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের ধরন, ব্যাপ্তি, অংশগ্রহণকারীদের চরিত্র, পূর্বতন অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদির মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক, অন্যথায় আমাদের মতো দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। দ্বিতীয়ত, প্রস্তুতি ও উপকরণের সমাহার করা। এ ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের প্রশাসন, সচিবালয়ের। প্রস্তুতি ও উপকরণের সমাহার ঘটানোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা যথেষ্ট যোগ্য। তৃতীয়ত, ব্যবস্থাপনা। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সব সদস্যের মাঠপর্যায়ে বিন্যাস, পরিবেশ সৃষ্টি, সমতল ক্ষেত্র তৈরি করা, নির্বাচনী আইনের প্রয়োগে ভোটারদের ভোট নিশ্চিতকরণ এবং ভোট গ্রহণের দিন সার্বিক ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখা। ওপরের আলোচনার নিরিখে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দুটি উপাদানে যথেষ্ট অপরিপক্বতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথমত, নির্বাচনের পরিকল্পনার আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সার্বিক বিবেচনা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পূর্বতন অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে পরিবেশ সামাল দেওয়ার পন্থা অবলম্বন করা যেত। হয়তো সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে অপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে নির্বাচন না করে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনের মতো সিংহভাগ উপজেলার নির্বাচন একধাপে সম্পাদন করা যেত।
আইনগত বা অন্য কারণে কিছু উপজেলা বাদ পড়লে সেগুলোতে ভোট গ্রহণ করা যেত পরবর্তী পর্যায়ে। ধাপে ধাপে করতে গিয়ে পরিকল্পনায় যে ত্রুটি দৃশ্যমান হয়, তা হলো আঞ্চলিক বা বিভাগীয় পর্যায়ে ধাপ নির্ণয় না করে একই জেলায় কয়েক ধাপে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। ধাপে ধাপে নির্বাচনের যে সুবিধা, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি, তাও খুব কার্যকর দেখা যায়নি। সেনাবাহিনী নিয়োগ করলেও তাদের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যায়নি। কারণ, ফৌজদারি বিধিতে নিয়োগ আর নির্বাচনী আইনের আওতায় নিয়োগের মধ্যে প্রক্রিয়াগত অনেক তফাত রয়েছে। সে কারণে চতুর্থ ধাপ নির্বাচনের আগে সিআরপিসির ধারা ১৩১-এর উল্লেখ করে চিঠি দিতে হয়েছে। উল্লিখিত ফৌজদারি ধারার আঙ্গিকে নির্বাচনী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। এত স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরেও নির্বাচনে নিয়োজিত কেন্দ্র ও বুথ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেশ কিছু জায়গায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের বাহিনী নিয়োগ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য নির্বাচন কমিশন এখন স্বীকার করেছে যে ধাপে ধাপে নির্বাচনের পরিকল্পনাই সঠিক ছিল না। দ্বিতীয় উপাদান নির্বাচন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান শৈথিল্যের কারণে ক্রমেই নির্বাচনে সহিংস ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও সহিংসতা ও অনিয়মের কারণে দুটি উপজেলা এবং মোট ১১৭টি কেন্দ্র স্থগিত করা হয়, তথাপি এই পরিসংখ্যান হিমশৈলের দৃশ্যমান অংশমাত্র। ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়ম ঘটা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। কয়েকটি উপজেলায় নির্বাচনী পরিবেশ যে একেবারেই ছিল না,
তা নির্বাচনপূর্ব সময়ে মিডিয়াতে ব্যাপক আলোচিত হলেও সেগুলো কমিশন আমলে না নেওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। পৃথিবীর কোনো দেশে শতভাগ বিশুদ্ধ নির্বাচনের দাবি করা যায় না। তবু কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে ১৯৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোর ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। ওই সব নির্বাচনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটলেও তা প্রকট ছিল না। ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সর্বস্তরের নির্বাচনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতটা ব্যাপক ছিল না। ২০০৯ সালের তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করলেও এ বক্তব্যের সত্যতা মিলবে। ওই নির্বাচনে বিশৃঙ্খলার কারণে ভোট গ্রহণের আগের রাতে দুটি উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করা হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অপর দিকে নির্বাচনের দিন কারচুপি ও অব্যবস্থাপনার কারণে চারটি উপজেলায় ভোট গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে স্থগিত করা হয়, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মিডিয়া ও অন্যান্য সূত্রে অনিয়মের অভিযোগে ১৬টি উপজেলার ফলাফলের গেজেট স্থগিত করা হয়। ৪৮টি কেন্দ্রসহ স্থগিতের কারণ নিরূপণে বিচারিক হাকিমের তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই মাস তদন্ত করা হয়েছিল। একটি কেন্দ্র স্থগিতের নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে পরবর্তী পর্যায়ে আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। অবশেষে ২০১১ সালে আপিল বিভাগ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার সমর্থন করে রায় দিলে ওই কেন্দ্রে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে পেরেছিল।
পরবর্তী সময়ে অন্যান্য নির্বাচনে তেমন বেগ পেতে হয়নি। পরিশেষে উল্লেখ করতে হয়, চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের তর্কিত পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব ব্যাপকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপরই বর্তায়। এত কিছুর পরেও আশা করা যায়, নির্বাচন ব্যবস্থাপক সংস্থা নির্বাচন কমিশন নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিলে হয়তো আগামী নির্বাচনগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবে। কিছুটা হলেও আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে পারবে। সামনে পৌরসভা ও সবচেয়ে জটিল ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এখনই অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার প্রত্যয় কিছুটা হলেও প্রকাশ পাবে। অন্যথায় নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় যে ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়েছে, তা আরও অবনতির দিকে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হবে এবং সার্বিকভাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী সংস্কৃতির অবনতির যে পরিণতি হবে, তা সুখকর হওয়ার নয়। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচন কমিশনের একক বিষয় নয়; সব রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্বই বেশি। আমরা আশা করি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করবে নির্বাচন কমিশন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.