বিড়াল দশতলার ছাদে উঠছে

লেখার বিষয় এত বেশি যে, ঠিক করতে পারি না কী নিয়ে লিখব। আজ মনে হলো পাঠকের সঙ্গে একটু হালকা আলাপই করি। নইলে সম্পর্কই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। নারী জাতি কেন বিড়ালকে এত পছন্দ করে, এই নিয়ে মনীষীরা অনেক ধন্দে থাকেন। কারণ, একটি পুরুষের যেসব গুণকে তারা ঘৃণা করে, তার প্রায় সবই বিড়ালের মধ্যে আছে। সে স্বাধীন থাকতে ভালোবাসে এবং কারও কথা শোনে না। ডাকলে কাছে আসে না, বাইরে রাত কাটাতে পছন্দ করে এবং যখন বাড়ি ফেরে, তখন একা থাকাটাই তার পছন্দ, এবং সে ঘুমাতে খুব ভালোবাসে। বিড়াল হলো বাঘ-সিংহের আত্মীয়, তাই হয়তো ওর অহংবোধ অত্যন্ত বেশি। আলাদা একটা ভাব নিয়ে থাকতে পছন্দ করে সে। ওর চালচলনে খেয়াল করেছেন না, রয়েছে কেমন একটা রাজকীয় ঢং? নিমকহারামও বটে এই মার্জার জাতি। আমার নানি বলতেন, বিড়ালকে কখনো বিশ্বাস করিস না। ওরা নিমকহারাম। কুকুর সব সময় সৃষ্টিকর্তাকে বলে—প্রভু, আমার গৃহকর্তাকে আরও ধনসম্পদ দাও, আমি খেয়েদেয়ে সুখে থাকি; আর বিড়াল বলে—হে প্রভু, আমার গৃহকর্তাকে অন্ধ করে দাও, আমি তার পাতের মাছটা যেন অনায়াসে খেতে পারি। ওদের নিমকহারামির একটি ঘটনা বলি, শোনেন। আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের আগে একটি বিড়াল খুঁজে আনা হলো, তাকে পোষ মানিয়ে অভিনয়ও করাল বিপাশা। কিন্তু তার পরই একদিন হঠাৎ কী জানি কী কারণে খামচে-খুমচে একাকার করে পালাল সে।
বোধ হয় সিনেমায় অভিনয় করাটাই তার উদ্দেশ্য ছিল। সেটা হাসিল হতেই পলায়ন! বিড়াল নিয়ে এত আলাপ-আলোচনার কারণটা বলি। ইদানীংকালে আমি একটা কাজ উপলক্ষে ঘুরে বেড়ালাম দেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল, তারপর ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল। ঘটনাটি ঘটেছিল ২ এপ্রিল, যশোরে। ভোরে ঘুম ভেঙে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা কালো বিড়াল। গা-টা ছমছম করে উঠল, যদিও এসব মানি না; তার পরও মনটাতে কু-ডেকে উঠল। সন্ধ্যায় কাজ সেরে ফরিদপুরের দিকে রওনা হয়েছি, মোবাইল ফোনে কল এল: ফরিদপুরের এলজিইডি রেস্টহাউসে মন্ত্রী উঠেছেন দলবল নিয়ে। আমাদের জায়গা হবে না। তারপর বেশ বেগ পেতে হয়েছে রাতে থাকার ব্যাপারে। বেটা অশুভ বিড়াল, তারও কদর কত মানুষের কাছে! বিড়ালের অসাধারণ গুণের কথা শোনেন। এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর বিড়াল-প্রেমে বিরক্ত হয়ে বিড়ালকে ব্যাগে পুরে শহরের ভিড়ে ফেলে দিয়ে এলেন। বাড়ি ফিরে দেখেন, বিড়াল তাঁর আগে বাড়ি ফিরেছে। পরদিন দূরের এক শহরে ছেড়ে দিয়ে এলেন, সেদিনও বিড়াল আগে বাড়ি এসে হাজির। তার পরদিন দূরে পাহাড়ের পেছনে জঙ্গলে ছেড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর বাসায় ফোন স্ত্রীকে: ‘হারামজাদা বিড়ালটাকে ফোনটা দাও তো, আমাকে বাড়ি ফেরার রাস্তা বাতলে দেবে।’ আর একটি গল্প। এক ভদ্রলোককে বাগানে গর্ত করতে দেখে পাশের বাড়ির ভদ্রলোক জানতে চান, তিনি কী করছেন।
‘আমার গোল্ডফিশটা মারা গেছে, ওকে কবর দেব।’
‘তার জন্য এত বড় গর্ত কেন?’
‘কারণ ওটা তো আপনার বিড়ালের পেটে রয়েছে।’ এক ভদ্রলোকের প্রাণপ্রিয় বিড়ালের মৃত্যুর কাহিনি দিয়ে শেষ করি কড়চা। ভদ্রলোক বিদেশে গিয়েছেন কাজে। তাঁর কেয়ারটেকারের কাছ থেকে মেসেজ পেলেন—‘স্যার, আপনার বিড়ালটা মারা গেছে।’ তিনি এই সংবাদে খুবই মর্মাহত হলেন এবং এভাবে সংবাদটা দেওয়ার জন্য বাড়ি ফিরে কেয়ারটেকারকে ভালো করে বোঝালেন, ‘শোনো, এভাবে কখনো প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদ দিতে নেই, তাতে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেমন, দুঃখে আমার স্ট্রোক হয়ে যেতে পারত। আমি মারা যেতে পারতাম অথবা সারা জীবন পঙ্গু হয়ে থাকতাম স্ট্রোকের কারণে।’ ‘তাহলে এ ধরনের সংবাদ কীভাবে দেব, স্যার?’ জানতে চাইল কেয়ারটেকার। ‘ধীরেসুস্থে দিতে হয়। যেমন, প্রথমে তুমি একটা মেসেজে বলতে পারতে—স্যার, আপনার প্রিয় বিড়ালটা দশতলার ছাদে উঠেছে, কিছুতেই নামছে না। পরের মেসেজে বলতে পারতে, স্যার, বিড়ালটা দশতলার ছাদ থেকে নামতে গিয়ে আহত হয়েছে, তার চিকিৎসা চলছে। শেষ মেসেজে বলতে পারতে, স্যার, পারলাম না তাকে বাঁচাতে। বুঝেছ?’
‘জি স্যার।’ বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকায় কেয়ারটেকার। এর কিছুদিন পর আবার বিদেশ গেছেন ভদ্রলোক। এবার তিনি কেয়ারটেকারের কাছ থেকে মেসেজ পেলেন— ‘স্যার, আপনার আম্মা দশতলার ছাদে উঠেছেন, কিছুতেই নামছেন না।’ বাংলাদেশে চতুর্থ দফার উপজেলা নির্বাচনের পর বলা যায়, আমাদের নির্বাচন কমিশন দশতলার ছাদে উঠছে।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.