সাথি পুরুষও পারেন ভ্রান্ত প্রথা বদলাতে by শীপা হাফিজা

আজ ৮ মার্চ—আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জাগ্রত সমাজ সমান অধিকার, উন্নয়ন ও শান্তির দাবিতে এ দিনটি পালন করে। এ বছর আন্তর্জাতিকভাবে Inspiring change প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

নারী উন্নয়নের বিভিন্ন উদ্যোগকে অনুপ্রেরণা প্রদান এবং সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে যদি মূলধারায় যুক্ত করা যায়, তাহলে সমাজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব। পরিবর্তনের লক্ষ্যে গৃহীত উদ্যোগগুলোকে যদি উৎসাহ-অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায় আর সহযোগী বাড়ানো যায়, তাহলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। অন্যভাবে বলা যায় যে অর্জনযোগ্য পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে উন্নততর পরিবর্তন আনয়নে উৎসাহী করা যায়। সমাজে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো ঘটতে দেখে সবাই উৎসাহী হয় যে—‘পরিবর্তন করা সম্ভব।’ আর তখনই তারা আরও বৃহত্তর পরিবর্তন আনয়নে উদ্যোগী হয়। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই এবার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও ঘরের মধ্যে কিন্তু নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি। দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮৫ শতাংশ নারীর উপার্জনের স্বাধীনতাও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে চালানো জরিপ প্রতিবেদন থেকে আমরা এই তথ্য পাই।
এই Inspiring change বা উদ্দীপনা জাগানো পরিবর্তন আনয়নে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে সমাজের, বিশেষ করে একশ্রেণীর অধিকার নির্ধারকদের অত্যাচারী মনোভাব, যা নারীকে অবদমন করে, যার বহিঃপ্রকাশ নারী নির্যাতন। নারী নির্যাতন আমাদের দেশে নিত্যনতুন আতঙ্ক নিয়ে দেখা দিচ্ছে। সাধারণ নির্যাতনের পাশাপাশি চলছে ধর্ষণ, দলগত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ চরম নিষ্ঠুরতা। ব্যক্তির অমানবিক আচরণ গোষ্ঠীর ওপরও প্রভাব ফেলছে।
সারা বিশ্বে একদিকে যখন জোরদার হচ্ছে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, তখন আমাদের দেশের নারীরা বহুভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন আর নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অগণিত নারী, কন্যাশিশুর মানসিক-শারীরিক নির্যাতনসহ ভয়াবহ নানা সহিংসতার চিত্র যেন নিত্যদিনের ঘটনা। ফলে নারীর জীবন হচ্ছে নিরাপত্তাহীন। ব্যাহত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এমন সব ঘৃণ্য নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীরা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে অকালমৃত্যু ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে। এসব কারণে সমাজ ও জাতি হারাচ্ছে সামগ্রিক সুস্থতা। তাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নের গতি।
বাংলাদেশে শুধু নারী নির্যাতনের কারণে প্রতিবছর ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, যা বাংলাদেশে মোট জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ০৫ শতাংশ। নির্যাতিত নারীর চিকিৎসা, বিচার-প্রক্রিয়া সম্পাদন, বিচারপ্রার্থী ও আসামির আদালতে যাতায়াত, খাবার, পেনালটি এবং সালিস আয়োজনে এই পরিমাণ টাকা খরচ হয়। কেয়ার বাংলাদেশ পরিচালিত ‘নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা: বাংলাদেশ-এর জন্য কতখানি অর্থমূল্য দিচ্ছে’ শীর্ষক এক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। নির্যাতিত নারীর মানসিক ধকল, তার সন্তানদের মনঃসামাজিক অবস্থা, কাজে অনুপস্থিতি বা কর্মঘণ্টার ব্যত্যয়, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বিবেচনায় নিতে পারলে এই খরচের হিসাব আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে বলে আমাদের ধারণা।
ইউএন উইমেনের এক জরিপ মতে, নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে দেশের মোট আয়ও কমছে বছরে অন্তত ২ দশমিক ১২ শতাংশ। যার পরিমাণ এক হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।
পুষ্টির ক্ষেত্রেও ভয়ানক বৈষম্যের শিকার আমাদের দেশের নারীরা। ২০১১ সালের পুষ্টি জরিপ মতে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের বেশি নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। পুষ্টিহীনতার কারণে ৫৪ শতাংশ অর্থাৎ ৯৫ লাখ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ৫৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় কম ওজন নিয়ে।
অসচেতনতা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নারীরা যথাযথ খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সব সময়ই নিজেকে বঞ্চিত করে। মেয়েশিশুরা ছোটবেলা থেকেই ছেলেশিশুর তুলনায় কম খাবার খেতে পায়। যে নারী হাঁস-মুরগি পালন করে, সে-ই তার ছেলেশিশু ও পরিবারের পুরুষ সদস্যের পাতে ডিম-দুধ-মাছ-মাংস তুলে দেয়। মা একই সঙ্গে মেয়েশিশু ও নিজেকে বঞ্চিত করে পুরুষ সদস্যকে ভালো জিনিসটা বেশি পরিমাণে খাওয়ায়। এই মেয়েশিশুটি বেড়ে ওঠে অপুষ্টিতে ভোগে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিণত বয়সের আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হওয়ার পরও সে বঞ্চিত হয় প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও খাবার থেকে। এরপর অপুষ্টিতে ভোগা এই শিশুমেয়েটিই আবার মা হয়। একটা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়। এভাবে অপুষ্টির চক্র চলতেই থাকে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে শুধু নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকেও দুর্বল করে দেয়।
নারী নিজের ও নিজ কন্যার পাতে কম দিয়ে স্বামী বা পুত্রসন্তানের পাতে ভালো খাবার পরিবেশন করে। কারণ, সমাজ তাকে এটাই শিখিয়েছে এবং এ কাজটিই সামাজিকভাবে স্বীকৃত। এতে নিজের, সমাজের এবং জাতির ক্ষতি হচ্ছে। এই সর্বনাশা সনাতন সামাজিক প্রথা ও আচার-আচরণকে পরিবর্তন করতে হবে। ঘরের সাথি পুরুষও পারেন এই ভ্রান্ত প্রথা বদলাতে, নারীর প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে। নারীকে অধস্তন অবস্থায় রেখে নিজেকে এবং দেশকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার প্রধান কারণই হচ্ছে বিষয়টির প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবনে অজ্ঞতা।
এই অবস্থায় এ কথা ঠিক যে এখনো আমাদের নারী দিবস পালন করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সুবিশাল অবদানকে সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হচ্ছে, এটা মোটেও অভিপ্রেত নয়। কুম্ভকর্ণের ঘুম যে কবে ভাঙবে!
অসচেতন ও দায়িত্ববর্জিত ব্যক্তি বা সমাজ মাঝেমধ্যে দিবস উদ্যাপন করা নিয়ে কটাক্ষ করলেও খবরাখবর ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজের জানাবোঝাকে প্রসারিত করার সুযোগ পায়। ফলে নারী-পুরুষ সমতার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ও শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকে, অজ্ঞতা কমে।
এই দিনকে উপলক্ষ করে সদা প্রান্তিকে অবস্থানরত নারী ও তার জীবনগাথা জনসমক্ষে তুলে ধরার আর প্রশংসা করার সুযোগ তৈরি হয়। কিছু নারী বছরে এক দিনের জন্য হলেও নিজেকে চেনার সুযোগ পায়। তার অবদান ও অবস্থানকে মূল্যবান হিসেবে দেখতে পায়।
তবে আশার কথা, বিগত কয়েক দশকে আমাদের দেশে নারী-পুরুষ সমতার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক না হলেও এগোচ্ছে। এই অগ্রযাত্রায় নারী দিবস পালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, সমমনা ও উদ্যোগী নারী ও পুরুষকে চিহ্নিত করা যায় এবং কাজ ভাগাভাগি করা সহজ হয়। একে অপরের মাধ্যমে জানার আর জানানোর পরিধি বাড়ে। এ বিষয়ে কথোপকথনের, বোঝার ও প্রচারণার সুযোগ করে দেয়; যা বৈষম্যমূলক সমাজে প্রতিদিন এত গুরুত্বসহ চিন্তা করা হয় না। দিবস পালনের মাধ্যমে হাজার কোটি নারী ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী পুরুষের একাত্মতা প্রকাশের সুযোগ ঘটে। শক্তি, সাহস, অঙ্গীকার ও নিষ্ঠা বিনিময় হয়।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন—ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু, দুর্গম ও চরের বাসিন্দা, প্রতিবন্ধী, দলিত, যৌনকর্মী, হিজড়া বা অন্য কোনো যৌন বৈশিষ্ট্যের সম্প্রদায়—কোনো নারী ও শিশুই যেন উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে বাদ পড়ে না যায়। আমরা যদি মানুষের জীবনচক্রের সূচনা ও প্রাথমিক পর্যায়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিচর্যা করি, যদি আজকের মেয়েশিশু তথা ভবিষ্যতের নারীর জীবনে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা ও তার কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করি এবং তা দূর করার জন্য পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সাংস্কৃতিক-চেতনাগত, দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে উদ্যোগ নিই, তাহলে নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হওয়াটা মোটেও অসম্ভব ব্যাপার নয়।
বিশ্ব নারী দিবস ২০১৪-তে আমরা তারই সম্ভাবনা খুঁজি, পায়ের আওয়াজ পাই...।
শীপা হাফিজা: জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি ও মাইগ্রেশন কর্মসূচির পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.