ইউক্রেন কি চলেই যাবে রাশিয়ার দখলে? by রোকেয়া রহমান

কদিন আগেও ক্রিমিয়া নামটি সবার কাছে খুব বেশি পরিচিত ছিল না। ইউক্রেনের প্রত্যন্ত এ অঞ্চলটি ইতিহাসবিদদের কাছে কিছুটা পরিচিত ১৮ শতকের পঞ্চাশের দশকের একটি যুদ্ধের কারণে। কিন্তু হঠাৎ করেই এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ক্রিমিয়া রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মস্কো নাটকীয়ভাবে অঞ্চলটি দখল করে নেওয়ার পর সবার নজর এখন ক্রিমিয়ার দিকে। উপদ্বীপটি কার্যত এখন রুশ সেনাদের নিয়ন্ত্রণে, অথচ এলাকাটির ওপর সার্বভৌম অধিকার ইউক্রেনের। ক্রিমিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর সাব ইউনিট ব্ল্যাক সি ফ্লিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি এবং রুশ ভাষাভাষীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। ২০১০ সালে এক চুক্তির আওতায় ওই নৌঘাঁটির ইজারার মেয়াদ ২০৪২ সাল পর্যন্ত বাড়ায় ইউক্রেন।
ক্রিমিয়ায় রুশ সেনার অনুপ্রবেশে অনেকে মনে করছেন, এটি ইউক্রেন দখলের প্রথম ধাপ। রাশিয়া ধীরে ধীরে ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য অংশও দখল করে নেবে। তবে সব লক্ষণ বিচারে এটা স্পষ্ট যে খুব শিগগিরই এই দখলদারি ছাড়বে না রাশিয়া। অনেকে বলছে, এটা প্রেসিডেন্ট পুতিনের সুস্পষ্ট ‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন’।
ক্রেমলিনের বর্তমান নেতৃত্ব কখনোই স্বাধীন ও সার্বভৌম ইউক্রেনকে মেনে নেয়নি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়ায় ১৯৯১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রাসেলসের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি ইউরোপের কর্মকর্তা আলরিচ স্পেক বলেন, ইউক্রেনের সমস্যাকে ক্রেমলিন সব সময় তাদের নিজস্ব ব্যাপার বলে মনে করে। কারণ, ওই ভূখণ্ড তাদের পুরোনো সাম্রাজেরই অংশ। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ১৮ শতকের শেষে রাশিয়ার দখলে আসা ক্রিমিয়াকে ৬০ বছর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট নিকিতা খ্রুশ্চভ ইউক্রেনের কাছে ছেড়ে দিয়ে যে ভুল করেছিলেন, পুতিন তা সংশোধন করতে চান। বিভিন্ন সময়ে পুতিনের কথাবার্তায়ও তা বোঝা গেছে।
২০০৮ সালে রোমানিয়ার বুখারেস্টে ভ্লাদিমির পুতিন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে এ কথা বলে চমকে দিয়েছিলেন, আপনাকে এটা বুঝতে হবে যে ইউক্রেন কোনো দেশ নয়। এটা পূর্ব ইউরোপের একটি ভূখণ্ড এবং এর বৃহত্তর অংশ আমাদের দেওয়া হয়েছে। ছয় বছর পর ক্রেমলিন যেন এটা নিশ্চিত করতে চাইছে যে পুতিনের সেদিনের কথাগুলো এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
পশ্চিমাদের বক্তব্যের ব্যাপারে মস্কো বলছে অন্য কথা। ক্রিমিয়ায় রুশ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাই তাদের উদ্দেশ্য। ইউক্রেনে রুশ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাতার ও অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরোধ আছে। রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তা জটিল রূপ ধারণ করেছে।
একদিকে রাশিয়ার সঙ্গে থাকার পুরোনো রীতি অনুসরণ, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে নতুন যুগে উত্তরণ—এই নিয়ে বিবাদের সূত্রপাত। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে এই নিয়েই ছিল ইউক্রেন উত্তাল। নাগরিকদের একটি অংশ মনে করছে মস্কোর সঙ্গে থাকলেই তাদের ভালো হবে। অন্য একটি অংশ মনে করছে মস্কোর প্রভাববলয় ছেড়ে ইউরোপের অংশীদার হলেই তাদের উন্নতি হবে। আর এই বিবাদ থেকে সূত্রপাত হয় আন্দোলনের।
২০০০ সালে রাশিয়ার ক্ষমতায় বসার পর থেকেই পুতিনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব থেকে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোকে মুক্ত রাখা। আর এ কারণে ইউরোপীয় ইউনয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি না করতে পুতিন ইউক্রেনের বিতাড়িত প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে দেড় হাজার কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। যা-ই হোক আন্দোলনের মুখে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ গত মাসে ক্ষমতা ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। ইয়ানুকোভিচের পতনের পরপরই ক্রিমিয়া দখলে নেয় রুশ সেনারা।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট বলেন, ইয়ানুকোভিচের পতনে ভয় পেয়েছে রাশিয়া। তারা ভেবেছে, এবার হয়তো নৌঘাঁটির ইজারা তারা হারাবে এবং এখান থেকে তাদের নৌঘাঁটি সরিয়ে নিতে হতে পারে। আর তা থেকেই এই ক্রিমিয়া-দখল।
এদিকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা মস্কোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের লড়াইয়ে যাবে না। কেননা ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীতে তহবিল ও অস্ত্রশস্ত্রের সংকট রয়েছে। তাদের সেনাসংখ্যাও রাশিয়ার তুলনায় অনেক কম। ইউক্রেন বাহিনীর পাশাপাশি কিয়েভের বর্তমান পশ্চিমাপন্থী নেতৃত্বও রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আগ্রহী নন। কারণ, তাঁরা ভালো করেই জানেন মস্কোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা জয়ী হতে পারবেন না। আর এ রকম হলে ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চল দখল করে নেওয়াটা মস্কোর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।
তবে রাশিয়ার এই আগ্রাসন আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক নিন্দা কুড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ না করতে মস্কোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে রাশিয়া ক্রিমিয়া থেকে সেনা সরিয়ে নেয়। সঙ্গে আছে জি-৮ থেকে বহিষ্কার, অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপসহ নানা হুমকি। সব মিলিয়ে ওবামা নরম-গরমে রাশিয়ার মত পাল্টানোর চেষ্টা করছেন।
কিন্তু পুতিনকে টলানো যাচ্ছে না। তাঁর পাল্টা হুঁশিয়ারি, জি-৮-এর সদস্যপদ খোয়ানোর আশঙ্কা বা অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়ে রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করা যাবে না। রাশিয়াকে চাপে ফেললে বাকিদেরও অর্থনৈতিক দিক থেকে ভুগতে হবে। পুতিনের এ কথাটা তাঁর পশ্চিমা ‘শত্রু’রা জানেন না তা নয়।
এর আগে ইরান ও সিরিয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠোর অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা থাকলেও সহিংস হতে পারেনি, বরং এখনো আরব বিশ্বের এই দুটি দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া চীনকেও পাশে পেয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কথায় যে বিশ্ব চলে না তা প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, গতকাল বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউক্রেন বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের এক জরুরি বৈঠক হওয়ার কথা। এ ছাড়া ব্রাসেলসে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যেও এক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গত বুধবার বৈঠক করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। এতসব বৈঠক ও আলোচনা রাশিয়ার মত পাল্টাতে পারে কি না তা এখন দেখার বিষয়।
সূত্র, সিএনএন, রয়টার্স ও এএফপি

No comments

Powered by Blogger.