ইউক্রেন সমস্যা- নতুন শীতলযুদ্ধের আলামত? by এম সাখাওয়াত হোসেন

পশ্চিমা বিশ্ব এখন ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে উত্তাল। যুক্তরাষ্ট্র এবং একসময়ের শক্তিধর প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বজাধারী রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের ভূ-রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইউক্রেনে মুখোমুখি।

ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সাবেক প্রেসিডেন্টের শাসনের অবসান ঘটিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ও সরকার গঠন করলে ইয়ানুকোভিচ ক্রিমিয়ায় পলাতক অবস্থায় ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অনুরোধ করার পর থেকে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান। ন্যাটোর সবচেয়ে শক্তিশালী সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার মুখোমুখি।
অপরদিকে ইউক্রেনের দক্ষিণের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ক্রিমিয়াতে রাশিয়ান বংশোদ্ভূতদের রক্ষার নামে রাশিয়া সেখানে সেনা সমাবেশ ঘটানোর সর্বশেষ খবর হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হচ্ছে ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়ার পার্লামেন্টের সদস্যরা বৃহস্পতিবার এর পক্ষে ভোটও দিয়েছেন। এখন গণভোটের অপেক্ষা। ফলে উত্তেজনা আরেক ধাপে উঠেছে।
রাশিয়ার পার্লামেন্ট একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের অঞ্চল ইউক্রেনে, বিশেষ করে ক্রিমিয়া রাশিয়ান ভাষাভাষীদের স্বার্থ রক্ষার্থে শক্তি প্রয়োগের অনুমোদনের পর থেকে সংকট চরমে উঠতে শুরু করে। ইউক্রেন তথা ক্রিমিয়াতে রাশিয়ার সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সরাসরি প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদ্দেশে ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করেনি। দুই প্রেসিডেন্টের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের নজিরও নিকট অতীতে নেই।
ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ক্রিমিয়া রাশিয়ার ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-কৌশলগত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড বলে বিবেচিত। ক্রিমিয়ার কৃষ্ণসাগরীয় ঐতিহাসিক বন্দর সাভাস্টোপোল রাশিয়ার ভূ-কৌশলগত অন্যতম নৌঘাঁটি। সাভাস্টোপোল বন্দর ২০৪২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার নিকট ইজারাভুক্ত। কোনো অবস্থাতেই এ সময়ে রাশিয়া সাভাস্টোপোলে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তার করতে দিতে রাজি নয়।
ইউক্রেনের বর্তমান সংকটের পেছনে পশ্চিমের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব যে রয়েছে, তা এখন আর নেপথ্যের বিষয় নয়। সংকটের সূত্রপাত হয় ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়ে। ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ বিগত নির্বাচনে নির্বাচিত হন। নির্বাচনকালে তাঁর নির্বাচনী ইশতিহারের মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেনের ইইউর অন্তর্ভুক্তির অভিপ্রায়। নির্বাচনের পর অন্তর্ভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করার পর থেকে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ যারা ইইউর পক্ষে রাজধানী কিয়েভে গণ-অভ্যুত্থানে যোগ দেন। অবশ্য ইইউতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি ক্রিমিয়ার রুশ ভাষাভাষীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বস্তুতপক্ষে রাশিয়া কোনোভাবে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির প্রয়াসকে সহজভাবে নেয়নি। এর অন্যতম কারণ ক্রিমিয়ার অবস্থান।
প্রসঙ্গত, ভূ-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ক্রিমিয়ার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৮.৫ শতাংশ রুশ ভাষাভাষী। বাদবাকি জনগোষ্ঠীর ২৪.৪ শতাংশ ইউক্রেনিয়ান এবং ১২.১ শতাংশ তাতার মুসলিম। রুশ ভাষাভাষীরা পক্ষে থাকলেও বাদবাকি দুই গোষ্ঠী রাশিয়ার বিপক্ষে রয়েছে। এতদঞ্চলে ইউক্রেনিয়ানরা বিগত শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে থেকে অন্যদের তুলনায় পশ্চাৎপদ থেকেছে। অপর দিকে তাতার মুসলমানরা নিগৃহ হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্টালিনের শাসনকালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশির ভাগ তাতারকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল নাৎসি জার্মানির সহায়ক হওয়ার অভিযোগে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেন কোন দিকে যাবে, রাশিয়া না ইইউতে? নাকি ক্রিমিয়া যুক্ত হবে রাশিয়ার সঙ্গে?
বিশ্বের নজর এখন ঐতিহাসিক অঞ্চল ক্রিমিয়ার দিকে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ক্রিমিয়াতে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে? অথবা ফিরে আসছে শীতল যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব? ক্রিমিয়ার পার্লামেন্টে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব পাস হওয়ার পর এবং এ নিয়ে ১৬ মার্চ গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ইইউ ও ইউক্রেন এর বিরোধিতা করেছে। ব্রাসেলসে জরুরি শীর্ষ বৈঠকে রাশিয়ার ওপর চাপ দেওয়ার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে এবং প্রয়োজনে অবরোধের কথাও বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, রাশিয়া ক্রিমিয়া থেকে সামরিক বাহিনী হটিয়ে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে সমীহ না করলে প্রথম ধাপে রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এমনকি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে আগামী মাসে রাশিয়ার মোচি শহরে অনুষ্ঠেয় জি-৮ শীর্ষ বৈঠক। জি-৮ থেকে বহিষ্কার অথবা শীর্ষ বৈঠক বাতিল হলে তা হবে রাশিয়ার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে, জি-৮ থেকে বহিষ্কার হবে রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যা।
যাই হোক, অন্যান্য প্রশ্নের বিশ্লেষণের আগে ক্রিমিয়ার বর্তমান অবস্থানের অতিসংক্ষিপ্ত ইতিহাসের উল্লেখ করছি। উনিশ শতকে ২৭-২৮ মার্চ ১৮৫৪ সালে ক্রিমিয়াতে ব্রিটিশ, ফরাসি এবং ওসমানীয় টার্ক বাহিনী তৎকালীন রাশিয়ান কামান বাহিনী আক্রমণ করতে গিয়ে যে পরিস্থিতিতে পড়েছিল তার কাব্যিক বিবরণ লর্ড আলফ্রেড টেনিসনের অমর কবিতা ‘দ্য চার্জ অব দ্য লাইট ব্রিগেড’-এ পাওয়া যায়। ওই যুদ্ধের ধ্বংসলীলার ছয় দিনের মাথায় এই কবিতা রচিত হয়েছিল। আরও ৪০ বছর পর রুডিয়ার্ড কিপলিং একই নামে আরেকটি কবিতা লেখেন। সেই থেকে ক্রিমিয়া তৎকালীন রাশিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হয়ে থাকলেও ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন বংশোদ্ভূত অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত করেন। সেই থেকে ক্রিমিয়া আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ইউক্রেনের অংশ হিসেবে অন্তর্গত রয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ক্রিমিয়া অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে রাশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল।
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। শুধু ইউক্রেনই নয়, ন্যাটো তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি রাশিয়ার ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করবে। সে ক্ষেত্রে ন্যাটোর পরিধি রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। রাশিয়া কিছুতেই এমনটা হতে দিতে রাজি নয়। রাশিয়ার কাছে ইউক্রেন অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার পশ্চিমমুখী গ্যাস পাইপলাইন ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে প্রবাহিত হচ্ছে। ইউক্রেনের ইইউতে অন্তর্ভুক্তি রাশিয়ার অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টি করবে। প্রসঙ্গত, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান অস্ত্র উৎপাদনকারী অঞ্চল ছিল ইউক্রেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রভাবের সমাপ্তি ঘটলে ন্যাটোর পর্যবেক্ষণে থাকবে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগরীয় নৌঘাঁটি-সাভাস্টোপোল, যা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।
এখানে উল্লেখ্য, সাভাস্টোপোল থেকে রাশিয়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে, বিশেষ করে সিরিয়ার সঙ্গে সরবরাহ লাইন চালু রেখেছে। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এ সংঘাতপূর্ণ অবস্থান এবং ইউক্রেনের ইইউতে অন্তর্ভুক্তি সিরিয়াতে তথা ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সরবরাহ লাইন বিঘ্নিত করবে। এ কারণেই মনে হয় ন্যূনতমপক্ষে রাশিয়া চাইবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির। আর সেটা করতে হলে শক্তি প্রয়োগের বিকল্প নেই। আলোচনার মাধ্যমে এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে কোণঠাসা করার সব উপায় অবলম্বন করবে। অপর দিকে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যেকোনো সময় থেকে বর্তমানে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার অক্ষ গড়ে উঠতে পারে। শুরু হতে পারে নতুন ধরনের শীতল যুদ্ধ, যা প্রভাবিত করবে আজকের একক বিশ্বকে। চীন-রাশিয়া অক্ষে উপমহাদেশের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও নাকচ করা যায় না। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক। পূর্ব-পশ্চিমের সংঘাত অথবা শীতল লড়াইয়ের ঠান্ডা ছোঁয়া বঙ্গোপসাগরের তটকেও আচ্ছন্ন করতে পারে। স্মরণযোগ্য যে বর্তমানেও ভারতের নৌবাহিনীতে রাশিয়ার প্রযুক্তি এমনকি অতি সম্প্রতি রাশিয়া থেকে পাওয়া পারমাণবিক সাবমেরিন এবং এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুক্ত হয়েছে। কাজেই ভারত মহাসাগরে রাশিয়ার প্রভাব নেই, তেমনটি নয়।
ফলে শীতল হাওয়ার যে ঝড় উঠবে, তা সুদূর চীন থেকে উপমহাদেশেও অনুভূত হবে। সে পরিস্থিতিতে বিশ্বে নতুন মেরুকরণের সূত্রপাত হতে পারে। কাজেই এ সংঘাত পরিস্থিতি শুধু ইউরোপের বিষয়ই নয়, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সমগ্র বিশ্বের শান্তির জন্য প্রয়োজন। এ কারণেই জাতিসংঘ তাদের উদ্বেগের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের কথা স্মরণ করিয়েছে। আমরা মনে করি, একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যেমন ওই রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থারও দায়িত্ব। অন্যথায় ভেঙে পড়তে পারে বিশ্বব্যবস্থা। হরণ হতে পারে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। পূর্ব বা পশ্চিমা শক্তির ইচ্ছায় নয়, ইউক্রেনের জনগণের মতামতেই নিষ্পত্তি হোক ইউক্রেনের সমস্যা। অন্যথায় পুনরায় শীতল যুদ্ধে জর্জরিত হবে বিশ্ব।

এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.