স্থানীয় সরকারের নামে ধোঁকা by মিজানুর রহমান খান

এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার যে উপজেলা নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন চলছে। এই প্রহসন নির্বাচন কারচুপি বা সহিংসতার নিরিখে নয়। বরং এটা হলো গভীর হতাশা থেকে উদ্ভূত, যার ভিত্তি হচ্ছে, ১৯৯২ সালের ৩০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া একটি মাইলফলক রায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে মিলে রায়টি লঙ্ঘন করে চলেছে। এবং আগামী জুলাইয়ে এ রায় লঙ্ঘনের ২২ বছর পূর্তি হবে।

নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না-হওয়া নিয়ে দুই দল ব্যতিব্যস্ত। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির ভোট কারচুপির গ্রহণযোগ্য অভিযোগগুলো গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম এবং আলোচনার মুখ্য খোরাকে পরিণত হয়েছে। অথচ আমরা যদি বাংলাদেশ সংবিধানের ৯, ১১, ৫৯, ৬০ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করি, যদি আমরা ১৯৯২ সালের কুদরত-ই-ইলাহী বনাম রাষ্ট্র মামলায় আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের নির্যাস গ্রহণ করি, তাহলে বলতেই হবে যে স্থানীয় সরকার নিয়ে জনগণকে চরম ধোঁকা দেওয়া অব্যাহত রয়েছে।
আপিল বিভাগ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, সামরিক শাসকেরা স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নাম বদলে পটুত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অভিনবত্ব এনেছেন। কিন্তু তাঁরা কখনোই সংবিধানের নির্দেশিত পথে স্থানীয় জনসাধারণকে তাঁদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা স্বায়ত্তশাসনের স্বাদ নিতে দেননি। গণতন্ত্রের লেবাসধারীরাও একই নায়ের যাত্রী। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা ও কার্যকারিতা পুরোনো আদলে রেখে নাম বদলে দেন। এরপর জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ধুয়া তোলেন। আগের মতোই পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসি ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি, মৎস্য ও পশুপালনের মতো কিছু বিষয় থানা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে আগের মতোই শ্বেতহস্তী অবস্থা বজায় রেখেই ‘থানা ও থানা পরিষদ’ শব্দ মুছে দিয়ে ‘উপজেলা ও উপজেলা পরিষদ’ পুনর্গঠন করেন। ২০০৯ সালে দেখতে হলো, ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের সভাপতি, সাংসদদের উপদেষ্টা আর নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা দ্বিতীয় উপদেষ্টা। অর্থাৎ শুভংকরের ফাঁকিটা চলছেই। সরকারি প্রচারযন্ত্রের কোরাস থামছে না যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটছে। এর অধিকাংশ প্রচারণা মিথ্যা ও প্রতারণার ওপর দাঁড়িয়ে।
বাংলাদেশকে ফেডারেল কাঠামো না করে এককেন্দ্রিক সরকার করা হয়েছিল। তবে সংবিধানপ্রণেতারা দুধের স্বাদ কী, সেটা জনগণকে দিতে চেয়েছিলেন। তাই অন্তত ঘোল হিসেবে ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ সংযোজন করেন। কিন্তু পরিহাস হলো, আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের চপ্পল থেকে বাংলাদেশ কখনো বের হতে পারেনি। সামরিক, আধা সামরিক ও গণতন্ত্রের লেবাসধারী সরকারগুলো কখনো ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সত্যিকারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চায়নি। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে, বিশেষ করে উপজেলা ব্যবস্থা ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা যতই বলা হোক না কেন, সংবিধান লঙ্ঘন চলছেই।
এই ব্যবস্থাকে শাসকেরা গণতন্ত্রের একটি লেবাস হিসেবে রাখতে চান। তাঁরা সম্ভবত মানুষকে ভাঁওতায় রাখার পণ করেছেন। সংবিধান ও রায় কিছুই তাঁরা মানবেন না। এ দুটি অনুচ্ছেদের করুণ ইতিহাস তাই নির্দেশ করে। চতুর্থ সংশোধনীতে এ দুটি অনুচ্ছেদ মুছে ফেলা হয়। এমনকি ১১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের কথাটিও বাকশাল নিতে পারেনি। আর বাকশালকে তুলাধোনা করতে করতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তাঁর উত্তরসূরিরা জ্ঞাতসারে একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। সে কারণেই পঞ্চম সংশোধনীতেও ওই দুটি অনুচ্ছেদ জ্যান্ত করা হয়নি। এমনকি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী পাসের আগ পর্যন্ত এ দুটি আর কখনো ফিরে আসেনি। আমরা যে অনেক সময় বলি, রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শ্রেষ্ঠতম ও শেষ কথা, সেটা এ ক্ষেত্রেও একটি নজির। কারণ, ওই দুটি অনুচ্ছেদ থাকা আর না থাকার মধ্যে শাসকগোষ্ঠী কোনো পার্থক্য রাখেনি। এখনো রাখছে না।
আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কেবল উপজেলা নয়, গোটা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাটাই কমবেশি সংবিধান লঙ্ঘন করে চলেছে। আপিল বিভাগ বলেছিলেন, আগে ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। অতঃপর ৬০ অনুচ্ছেদ কার্যকর করা সম্ভব কি সম্ভব নয়, সেই প্রশ্ন আসবে। সুতরাং ৬০ অনুচ্ছেদমতে, কর আরোপ ও বাজেট প্রণয়নের মতো এখতিয়ারের প্রকৃত অর্থপূর্ণ অনুশীলন নিয়ে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক থাকছে।
সামরিক শাসনামলে যে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা ১৯৯২ সালে বাতিল হয়েছিল। তার কারণ ছিল একটি মাত্র বাক্য। ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে আমাদের নির্বাচিতের বড়াই করা শাসকেরা ওই টেকনিক্যাল ত্রুটি শুধরে নিয়েছেন। যদি প্রশ্ন করা হয়, সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ লড়াই শেষে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় জনগণ কি পরিবর্তন দেখতে পেয়েছে? এর উত্তর হলো, ‘প্রশাসনিক একাংশ’ শব্দটি সরকারি কালিতে মুদ্রিত হয়েছে। তাঁরা ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিতে পারতেন। কিন্তু তা তো তাঁরা করেনইনি, বরং বিদ্যমান বিধানমতে প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন স্থানীয় সরকারের দায়িত্বের সনদে প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্ত এবং তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। বরং আইনশৃঙ্খলার মতো স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি পদে ইউএনওরা আছেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রায়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যদি সরকার তার কর্মকর্তা ও খয়ের খাঁদের দিয়ে স্থানীয় সরকার চালাতে চায়, তাহলে স্থানীয় সরকার বলতে আর কিছু থাকবে না।’ আমরা তো কেবল মনোনীতদের মধ্যে নয়, বহু ক্ষেত্রে নির্দলীয় নির্বাচিত নেতার মধ্যেও ওই ‘খয়ের খাঁ’ দেখতে পাই।
২২ বছর পরে এই ২০১৪ সালেও আমাদের আপিল বিভাগ, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কী আশ্চর্য প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বলেছিলেন, অতীতের স্বৈরাচার সরকারগুলো সংবিধান স্থগিত কিংবা ধ্বংস করে দিয়ে এবং জাতীয় সরকারব্যবস্থায় গণতন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে তৃণমূলে সাচ্চা গণতন্ত্র দিতে ছুটেছে। তারা নাম বদল করে বলেছে, এই নাও অধিকতর গণতন্ত্র দিলাম। কিন্তু এসব ‘গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ’ জনসাধারণের সামান্য আস্থা অর্জন করেছে। আর এ সবই জনসাধারণ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ভাঁওতা দেওয়ার জন্যই। এটা একটা পরিহাস যে ২২ বছর পরেও আপিল বিভাগের এই পর্যবেক্ষণ একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে, নাকি আরও প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেছে, তা একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন বটে।
অন্যদিকে সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলন অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারার সঙ্গে যে গণতন্ত্রের যোগসূত্র রয়েছে, তা এই রাষ্ট্রের সর্বত্র অনুচ্চারিত। উপজেলা পরিষদ কীভাবে কী কাজ করবে, তা এখন পর্যন্ত বিতর্কের বিষয়। অবশ্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ও চূড়ান্ত কোনো একটি লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাজনৈতিক ইচ্ছা আমরা যথারীতি অনুপস্থিত দেখি।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে পরামর্শ করে উপজেলা পরিষদকে চলতে হবে বলে ২০০৯ সালে যে আইন করা হয়েছে, তা ভদ্র সমাজ হলে ক্ষতির কারণ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্থানীয় সাংসদ অনেক স্থানে উপজেলা পরিষদে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। উপজেলা চেয়ারম্যানরা স্থানীয় সংসদের হস্তক্ষেপ না চাওয়ার দাবি জনপ্রিয় করতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও নিজেদের কোনো সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে দিতে চান না। কারণ, তাঁরাও নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পছন্দ করেন। এমপির হস্তক্ষেপ নয়, যে যেখানে আছেন, নিজের ওপর কেউ কারও হস্তক্ষেপ চান না।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে স্থানীয় সাংসদের, উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যানের এবং তাঁদের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্নায়ুযুদ্ধ সহজেই বোধগম্য। এ বিষয়ে এমন একটি আলোচনা চলমান হওয়া দরকার, যেটা হতে হবে সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সংবিধানসম্মত।
বছরে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা উপজেলা পরিষদ সরাসরি খরচ করলেও ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তদারকিতে ব্যয় হয়ে থাকে। সুতরাং এ তথ্যই নির্দেশ করে যে উপজেলা ব্যবস্থায় কে জমিদার আর কে প্রজা? ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের সচিব করা হয়েছিল। এতে তাঁরা রুষ্ট হলে তাঁদের মুখ্য নির্বাহী করা হয়। সংবিধান বা আইনের কোথাও ডিসি মানে জেলা প্রশাসক স্বীকৃত নয়। কিন্তু মানুষ ঠকাতে ডিসির বাংলা ভাষান্তর হিসেবে জেলা প্রশাসকই চালানো হচ্ছে। আর জেলা পরিষদগুলোতে এই সরকারও যথারীতি ‘খয়ের খাঁ’ রেখে দিয়েছে। সুতরাং বাস্তবতা হচ্ছে, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রস্তাবিত ‘প্রশাসনিক একাংশ’ এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
১৯৯২ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, স্থানীয় সরকারকে সবল ও সংবিধানসম্মত করতে একটি কমিশন করা হয়েছে। এরপর আরও কত কমিশন হলো, কিন্তু গল্প ফুরাল না। দুই শর্ত দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। প্রতিটি স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকবে। প্রশাসনিক একাংশ হতে হবে। বাস্তবতা হলো, বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ প্রতিটি জেলায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অনুপস্থিত। সরকারি কালিতে অবশ্য ‘প্রশাসনিক একাংশ’ আছে, তাই তাদের আইন ‘অমান্যকারী’ বলা যাবে না। সরকার শুধু একাই সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য করছে তা নয়, একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও করছে। কারণ, অনধিক ছয় মাস সময়ের মধ্যে স্থানীয় সরকারের সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে কখনো উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। তারা সংবিধান বোঝে না, সুপ্রিম কোর্টের রায় বোঝে না। মামুলি আইন, যেখানে লেখা আছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কখন হবে, তা সরকার ঠিক করবে—এই কথাটিতে তাদের আস্থা এভারেস্টতুল্য।
নির্বাচনী সহিংসতা ও কারচুপিজনিত বাদানুবাদের মধ্যে আমরা কাদের ভোট দিই, কেন দিই, তাদের কী কাজ করা উচিত, আর কী করে, সেদিকে মনোযোগ আনতেই সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন স্মরণে আনলাম। কয়েক বছর সরকারগুলো ওই সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়েছে। ওই রায়ের প্রতি সম্মান জানাতে আমাদের গণতান্ত্রিক সৈনিকেরা ভীষণ ক্লান্ত।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.