ভারতের নির্বাচন এবং ব্র্যান্ড নমো by কামাল আহমেদ

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নির্বাচনসামগ্রী বিক্রির শীর্ষে রয়েছে আম আদমি পার্টির নাম অথবা প্রতীকসংবলিত নানা ধরনের পণ্য; যেমন—টি-শার্ট, টুপি, চায়ের মগ ইত্যাদি। কিন্তু দেশটির প্রযুক্তি রাজধানী হায়দরাবাদে জায়গাটি নিয়েছে এনএএমও (নমো)। ব্লুপেজ ডট কম নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যসামগ্রী বিক্রির বিশদ পরিসংখ্যান দিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করেছে (এনডিটিভি, ৭ মার্চ, ২০১৪)।

এর আগে ২৪ ডিসেম্বর গুজরাটের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নমো পণ্য বিক্রির অনলাইন পোর্টাল চালু করে, যারা দাবি করেছে যে এসব পণ্য হচ্ছে নমো মন্ত্রের পণ্য। তাদের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘নরেন্দ্র মোদি ইন্সপায়ার্ড প্রোডাক্টস আর দ্য ওয়ে টু সে হোয়াট ইউ স্ট্যান্ড ফর’; যার বাংলা দাঁড়ায় ‘আপনার মূল্যবোধকে তুলে ধরার উপায় হচ্ছে সেই সব পণ্য, যেগুলো তৈরি হয়েছে নরেন্দ্র মোদির চেতনায়’ (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে)।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নরেন্দ্র মোদিকে (নমো) তাদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়; তার পর থেকেই সে দেশের গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্র্যান্ড হিসেবে নমোকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়।
২০০৯ সালের মে মাসের কথা। দিল্লির একটি আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী সন্দীপ দীক্ষিত। দিল্লির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের ছেলে সন্দীপের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন কংগ্রেসে গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকারী রাহুল গান্ধী। দিল্লির টেলিভিশনগুলোতে সন্ধ্যার সংবাদে সেই প্রচারাভিযান স্থান পাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না। সন্দীপ আউটলুক সাময়িকীকে জানিয়েছেন যে একটি টেলিভিশন চ্যানেল ওই খবরটি প্রচারের জন্য তাঁর কাছে টাকা দাবি করে জানিয়ে দেয়, তাদের চাওয়া পূরণ না হলে সেদিনের খবরে ওই প্রচারাভিযানের বিষয়টি জায়গা পাবে না।
আউটলুক সাময়িকী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এই আচরণ বা দুর্নীতির ওপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে অনেকগুলো সংবাদপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক সংবাদ প্রকাশের তথ্য বেরিয়ে আসে। পরে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (পিসিআই)ও বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য প্রেস কাউন্সিল তদন্তের প্রতিবেদন সম্পাদিত আকারে প্রকাশ করে, যাতে অপরাধী সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বাদ দেওয়া হয়। বিষয়টি অবশ্য আন্তর্জাতিক মাধ্যমের নজর এড়ায়নি। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি গার্ডিয়ান পত্রিকা সন্দীপের দৃষ্টান্তসহ এই ‘পেইড নিউজ’ সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে, যার শিরোনাম ছিল ‘ইন্ডিয়া: পেইড নিউজ স্ক্যান্ডাল হিটস মেজর নিউজপেপারস’।
গত পাঁচ বছরেও যে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি, তার প্রমাণ এবার তফসিল ঘোষণার সময় এই পেইড নিউজের ওপর নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
১২ বছর আগে নিজ রাজ্য গুজরাটে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার যে কালিমা নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিকে বিতর্কিত করে তুলেছিল, তা মুছে ফেলায় নমো ব্র্যান্ডের কৌশলী প্রচারবিদেরা যে যথেষ্টই সফল হয়েছেন, তার আলামত সুস্পষ্ট। আধুনিক ভারতের সবচেয়ে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর একটি যাঁর পৌরহিত্যে সংঘটিত হলো, তাঁর তরফে অনুশোচনা ও দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর পদোন্নতি ঘটছে। তাঁর রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকার অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁর প্রতিক্রিয়া নেই। দেশের বাইরেও তাঁর সুখ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তাঁর প্রবেশের ওপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।

কুশলী প্রচারবিদদের কল্যাণে অবশ্য তিনি সেসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে এখন সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল ভারতীয় শিল্প ও পুঁজিপতিদের সমর্থন আদায়। ফলে পশ্চিমবঙ্গে যখন টাটার ন্যানো গাড়ির প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলো, গুজরাট তখন তাঁকে লালগালিচা পেতে স্বাগত জানাল। মুখ্যমন্ত্রী মোদি যখন গুজরাটকে ভারতের সবচেয়ে বাণিজ্যবান্ধব রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন বাকি কাজটা যে বণিক গোষ্ঠীরাই করবেন, তাতে সন্দেহ কি? আর মুক্তবিশ্ব যেহেতু ছুটছে ওই পুঁজি আর বাজারের পেছনে, সেখানে ইউরোপ-আমেরিকার রাজনীতিকেরাও যে সুর বদলাবেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত তাই এখন ঘটা করেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গান্ধীনগর যান। অবশ্য বাংলাদেশের হাইকমিশনারও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। গত বছরের ২৭ জুলাই তিনি গান্ধীনগরে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন (সূত্র: নরেন্দ্র মোদির নিজস্ব ওয়েবসাইট)।
২০০২ সালের দাঙ্গায় হাজার খানেকের বেশি মুসলমান নিহত এবং লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার সময়টিতে দিল্লিতেও ক্ষমতাসীন ছিল তাঁর দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট। তখন অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাও একেবারে প্রশ্নাতীত নয়। দাঙ্গা-পরবর্তী গুজরাটে প্রথম যে নির্বাচনটি হয়, তার খবরাখবর নিতে সে সময়ে আমি আহমেদাবাদ গিয়ে সপ্তাহ খানেক ছিলাম। সেখানে মোদির নির্বাচনী প্রচারণার শেষ জনসভায় ছিল উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু গুজরাটের মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলো এবং দাঙ্গায় বাস্তুচ্যুতদের শিবিরগুলোতে তখন ছিল চাপা আতঙ্ক। তাঁর সমর্থনে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি সেই জনসভায় হাজির হয়ে মোদির উন্নয়ন মডেলের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। যদিও এবার বিজেপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নির্বাচনের বিষয়ে তিনি দলের মধ্যে বিরোধিতা করেছিলেন বলেই সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
২০০২-এর গুজরাট রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আইনজীবী ও রাজনীতিক অরুণ জেটলি। নির্বাচনী ফলাফলের দিন রাজ্য বিজেপির কার্যালয়ে আমি যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম, তখন বাইরে চলছিল বিজয় উৎসব। সে সময়েই উল্লাসরত সমর্থকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এনডিটিভিতে খবর দিচ্ছিলেন তারকা সাংবাদিক বোরকা দত্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে জানা গেল, বোরকা দত্ত শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। স্পষ্টতই সরাসরি সম্প্রচারে তাঁর কথাবার্তা সে সময়ে মোদি-সমর্থকদের ক্ষুব্ধ করেছিল। বোরকার লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাটি ছিল সংবাদমাধ্যমের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা—সমালোচনা তাঁদের পছন্দ নয়।
গুজরাটের দাঙ্গা এবং তার পরের কয়েক বছর মোদি যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে তাঁর সমর্থনের ভিত্তি সংগঠিত করেছেন, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষে বিষাক্ত। কিন্তু সর্বভারতীয় নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার পর থেকেই সেসব বক্তব্য ঝেড়েমুছে সাফ করা হয়েছে। গুজরাট দাঙ্গার ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র ফাইনাল সলুশন্স-এর নির্মাতা রাকেশ শর্মা এ রকম ডজন খানেক বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড সংকলন করে ইতিমধ্যেই তা প্রকাশ করেছেন। স্ক্রল ডট আইএন নামের একটি ওয়েবসাইটকে রাকেশ শর্মা আরও জানিয়েছেন যে আরও কিছু রেকর্ড তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবেন। তবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এসব প্রশ্ন এখন আর তেমন একটা উত্থাপিত না হওয়ায় তাঁর প্রচার উপদেষ্টাদের নমো ব্র্যান্ডিংয়ের কার্যকারিতার ইঙ্গিত মিলছে। রাকেশ শর্মা প্রশ্ন তুলেছেন, আহমেদাবাদের মুসলিম-অধ্যুষিত গুলবার্গ সোসাইটি কিংবা নারোদা পাতিয়ার জনবসতিগুলো এখনো কেন সরকারিভাবে গোলযোগপূর্ণ এলাকার বিশেষ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নমোকে ‘বিকাশ পুরুষ’ বা প্রগতির পুরুষ হিসেবে তুলে ধরার প্রচারণায় মূলধারার প্রচারমাধ্যম বা দলীয় সমর্থকদের সভা-সমাবেশ ছাড়াও নতুন মাধ্যমগুলোর ভূমিকাও কম নয়। ফেসবুক ও টুইটারের মতো মাধ্যমগুলোতে তাঁর সমর্থকদের সংগঠিত প্রচারণা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। তবে সেখানেও বিতর্কের শেষ নেই। ট্রুথ অব গুজরাট ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইটে মোদির টুইটার অ্যাকাউন্টের সমর্থকদের বৃত্তান্ত যাচাই করে দাবি করা হয়েছে যে তাঁর কথিত ২৫ লাখ সমর্থকের অধিকাংশই ভুয়া। টুইটারে মোদির ভুয়া অনুসারী বা ভক্তদের চিহ্নিত করার উপায় হিসেবে তাঁরা দেখিয়েছেন যে তাঁর প্রায় ৩৭ শতাংশ অনুসারী মাত্র একবারই টুইট করেছেন, ২৮ শতাংশের নিজের কোনো অনুসারী নেই এবং ১৬ শতাংশ কোনো টুইটও করেননি এবং তাঁদের অনুসারীও নেই। এসব বিশ্লেষণ সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মোদির পাল্লা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ভারী বলেই আভাস মিলছে।
মোদি সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে গুজরাটকে ভারতের অর্থনীতির মডেল হিসেবে দাবি করার ভিত্তি নেই (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২২ জুলাই, ২০১৩)। বিশেষ করে, সামাজিক সূচকগুলোতে রাজ্যটি অন্য অনেকের চেয়ে পিছিয়ে থাকাকেই তিনি এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অমর্ত্য সেন আরও বলেছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেখতে চান না। তারও আগে অক্সফোর্ডের ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং ভারতের জাতীয় অধ্যাপক ড. তপন রায় চৌধুরী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বহুবার তাঁকে গুজরাটের কসাই বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আপাতদৃশ্যে মনে হচ্ছে, বিজেপির প্রচার-কুশীলবদের রি-ব্র্যান্ডিং অভিযানের তোড়ে নৈতিকতার প্রশ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

No comments

Powered by Blogger.