রাশিয়া কত অরক্ষিত

ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং তার পরে সৃষ্ট ক্রিমিয়া সংকটকে ভুলক্রমে দ্বিতীয় দফা স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও জনমত উপেক্ষা করে ভ্লাদিমির পুতিন যা করছেন, তার প্রতিক্রিয়া পুঁজিবাদকে পরাস্ত করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘ প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ার চেয়ে অনেক আলাদা হলেও এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
রাশিয়া নিজেকে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিযুক্ত করার মুখে। এর মাধ্যমে দেশটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক নতুন যুগের সূচনা করবে। আন্তর্জাতিক অবরোধ শুধু প্রারম্ভিক প্রতিক্রিয়া। বাজার ও ব্যাংকব্যবস্থা অনিশ্চয়তা পছন্দ করে না। সুতরাং রুশ অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে ক্রমেই বেশি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। দেশটির প্রবৃদ্ধির গতি কমবে বা বন্ধ হয়ে যাবে। এটা অবশ্য রাশিয়ার বিষয়। বৃহত্তর পরিণতিটি হবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক বিরাট ধাক্কা। সুশাসন থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন পর্যন্ত অভিন্ন বৈশ্বিক নানা সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকারগুলোর প্রচেষ্টার ভিত নড়ে উঠবে। তবে এর ফল অবশ্য ইতিবাচকও হতে পারে। ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশগুলোর একটি নতুন ও উল্লেখযোগ্য রকম পুনর্বিন্যাসের পথও খুলে দিতে পারে। পাশ্চাত্যের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বৈরথের প্রথম ফলটি হবে ব্রিকসের অবসান। এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন এবং সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তারা শিল্পায়িত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া বিশ্ববাজার ও বহুপক্ষীয় ফোরামগুলো থেকে বহিষ্কার বা নিজে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একঘরে হতে চলেছে বলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দিন ঘনিয়ে এসেছে। ব্রিকস হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যাবে না। কিন্তু আজকের এই বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে বাকি বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার কোন্দলে জড়িয়ে অন্য চার সদস্যরাষ্ট্রের নিজেদের অবস্থান ঝুঁকিতে ফেলার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রিকস গোষ্ঠীর যে একটি সুসমন্বিত কণ্ঠস্বর আছে, সে ধারণা ধীরে ধীরে লোপ পাবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিজের কর্তৃত্ব জাহিরের নীতি অনুসরণ এবং ‘ইউরেশিয়ান ইউনিয়ন’ বাণিজ্য জোট গঠনে উদ্গ্রীব এক ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ রাশিয়া স্পষ্টতই হবে বিপজ্জনক। তবে এর আরও তাৎপর্যপূর্ণ ফলটি দেখা যাবে রাশিয়ার সাবেক ব্রিকস সহযোগীরা কীভাবে জি-২০ গোষ্ঠীর অন্য বিকাশমান অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক পুনর্বিন্যস্ত করে, তার মধ্যে। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বমঞ্চে আসছে মিকটা—মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া (দক্ষিণ), তুরস্ক ও অস্ট্রেলিয়ার নতুন জোট। এই দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে যৌথ আলোচ্যসূচি স্থির করতে শিগগিরই মেক্সিকোয় বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁরা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মিকটার ব্যানারে প্রথম বৈঠকে বসেছিলেন। তখন অবশ্য এ নতুন জোটকে এমন একটি ক্লাবের বেশি কিছু মনে হয়নি, যারা কিনা কোনো না কোনো কারণে ব্রিকসে ঢুকতে পারেনি, আবার তেমন বড় শক্তিও বলা যায় না।
রাশিয়ার নিজের ডেকে আনা সমস্যা এই ছবিটা একেবারেই বদলে দেবে। ব্রিকসের চেহারা প্রায় রাতারাতি পাল্টে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ফলে অভিন্ন উদ্বেগ আছে, এমন দেশগুলোকে নিয়ে আরও অনেক বড় একটি জোট গঠনের পথ সুগম হয়েছে। মিকটা দেশগুলোর অভিন্ন নানা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নিজের সীমান্তের বাইরে ক্রমবর্ধমান প্রভাব। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের কিছু সমস্যা আছে। তবে তারা অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার মডেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বিধিবিধানগুলো যেভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, তাতে এদের উল্লেখযোগ্য স্বার্থ রয়েছে। তাদের চ্যালেঞ্জ ও উচ্চাভিলাষের অনেকগুলোই বিকসের (রাশিয়া বাদে ব্রিকস) চ্যালেঞ্জ ও উচ্চাভিলাষের সঙ্গে মিলে যায়। অবশ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির ‘বর্ণমালা স্যুপ’-এ বিকস-মিকটার মতো দাঁতভাঙা নামের নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি জোট শেষ পর্যন্ত তেমন কার্যকর না-ও হতে পারে। তবে শেষ কথাটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে রাশিয়ার আসন্ন অনুপস্থিতি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে নতুন ভাবনার অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। এটি জি-২০-কে আবার চাঙা না ধ্বংস করবে, তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিগগিরই রাশিয়ার জি-৮-এর সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হবে (ইতিমধ্যে হয়েছে)। জোটটি ফিরে যাবে তার আদি রূপ জি-৭-এ, যার সদস্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে এতে জি-২০-এর কী পরিণতি হবে এবং রাশিয়া তাতে থেকে যাবে কি না, সেটা অস্পষ্ট। বৈশ্বিক ইস্যু মোকাবিলার কৌশল হিসেবে জি-২০-এর ভূমিকা কিছুটা হতাশাজনকই বলা চলে। আর উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে শীর্ষ শিল্পায়িত দেশগুলোর সঙ্গে একই জোটে অন্তর্ভুক্ত করার ধারণাটি এ পর্যন্ত পরিমাপযোগ্য সাফল্য বয়ে আনেনি। পরস্পর নির্ভরশীল আজকের বিশ্বে এখন স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এত বড় অংশকে পুতিনের দূরে সরিয়ে দেওয়া তাঁর নিজেরই ক্ষতি করবে। সমাজতন্ত্রের পতনের এক প্রজন্ম পরে রাশিয়ার অর্থনীতি এবং এর জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি শুরু হয়েছে। তবে দ্রুত হ্রাসমান জনসংখ্যা এবং কেবল জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরতার কারণে এই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বেশ নাজুক। ক্রেমলিন শিগগিরই দেখবে, এত দিন যতটা স্বীকার করেছে তারা আসলে বাইরের দুনিয়ার ঘটনাপ্রবাহের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি অরক্ষিত।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জাইলস মেরিট: ইউরোপস ওয়ার্ল্ড সাময়িকীর সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.