যোগ্যতার নাম ‘ছাত্রলীগ’ by এ কে এম জাকারিয়া

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক একটি লেখা লিখেছেন। এর শিরোনাম: ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’। হল উদ্ধারের আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যমে ঠাঁই পাচ্ছে। হঠাৎ কী হলো যে শিক্ষকদের এই শিরোনামে একটি লেখা লিখতে হলো? কারা এই ‘সন্ত্রাসী’? লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি; ‘শিক্ষার্থীদের হল উদ্ধারের যৌক্তিক দাবিতে শিক্ষকদের কোনো ভিন্নমত নেই। কিন্তু ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা ও ছাত্রলীগ নামধারী যে সন্ত্রাসীরা শিক্ষককে মেরে ফেলার হুমকি দেয়, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে, তাদের নেতৃত্বাধীন কর্মসূচিতে ন্যায্যতার প্রশ্নে শিক্ষকেরা কীভাবে অংশ নেবেন? (সমকাল, ১৯ মার্চ)।

শিক্ষকদের কাছ থেকে আমরা সন্ত্রাসীদের দলীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় পেলাম, কিন্তু কী করেছিল তারা? শিক্ষকেরা যা লিখেছেন, সংক্ষেপে সেটাই তুলে ধরছি। হল উদ্ধারসহ নানা দাবিতে গঠিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগের এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সৈয়দ আলম ১৩ মার্চ লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই শিক্ষক একসময় ছাত্রকল্যাণের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কমন রুমের জন্য টেন্ডারকৃত মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য যে কমিটি হয়েছে, তার আহ্বায়কের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর ওপর। ছাত্রলীগের নেতারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেই শিক্ষকের কক্ষে হাজির হয়ে ‘তাঁর মাথায়, বুকে ও পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে’ কমন রুমের কাজ শেষ হওয়ার প্রত্যয়নপত্র বের করে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন। তিনি অপারগতা প্রকাশ করায় ‘ওই উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীরা সৈয়দ আলমকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেন। স্বাক্ষর না করলে তাঁকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছেন এবং তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।’
ছাত্রদের হাতে শিক্ষক যখন লাঞ্ছনার শিকার হন, তখন তা শিক্ষকদের কতটা ব্যথিত ও মর্মাহত করতে পারে, তা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষকেরা তাঁদের সমিতির মাধ্যমে এই হামলার সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার, সনদ বাতিল, অস্ত্র আইনে মামলা ও গ্রেপ্তার করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান। এর প্রতিক্রিয়া ‘ছাত্র নামধারী’ সন্ত্রাসীরা আবারও শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেওয়া, শিক্ষকদের গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলা, হুমকি দেওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটায়।
১৩ মার্চ হামলার ঘটনার পর যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই লেখাটির কোনো দরকার হতো না। লেখায় ছাত্রলীগের কোন নেতার নেতৃত্বে হামলা হয়েছে, তাঁর সহযোগী কারা ছিলেন—সবই উল্লেখ রয়েছে। তার মানে, সবাই সবকিছু জানেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বা সম্ভব নয়। ছাত্রলীগ যাঁরা করেন, তাঁদের জন্য এই ছাড়টি যে দেওয়াই আছে!
শুধু এই ছাড়ে সম্ভবত ছাত্রলীগের হচ্ছে না। তাঁদের জন্য নানা ক্ষেত্রে আরও আরও ছাড় দরকার। এ ধরনের দাবিও ওঠা শুরু হয়েছে। ‘সাধারণত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে বিভিন্ন দাবি করেন। কিন্তু আজ তাঁদের পক্ষ থেকে আমিই ছাত্রলীগের প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে চাকরি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’ (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে এই দাবি তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল আজিজ। তিনি সরকার-সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নীল দলের আহ্বায়ক। তিনি মনে করেন, ছাত্রলীগ করাই চাকরির বড় যোগ্যতা। ‘যাঁরা দলের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের ভালো ফলাফলের প্রয়োজন নেই।’ আপাতত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন দাবি উঠেছে। দাবি যখন উঠেছে, আশা করা যায়, ভবিষ্যতে হয়তো এই বিধানও কার্যকর হবে!
১৩ মার্চ অধ্যাপক মোহাম্মদ সৈয়দ আলম ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হলেন, ১৭ মার্চ সেই রসায়ন বিভাগেরই আরেক শিক্ষক ছাত্রলীগের ‘প্রত্যেক নেতা-কর্মীর’ জন্য চাকরি চেয়ে বসলেন! আমাদের খুব জানতে ইচ্ছা করে, তাঁর বিভাগের একজন শিক্ষকই যে দিন চারেক আগে ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হলেন, সেটা কি তিনি জানতেন? আর না জানলেও কি একজন শিক্ষক এমন দাবি করতে পারেন? প্রথম আলোয় ‘ছাত্রলীগ করাই চাকরির বড় যোগ্যতা’—এই খবরটি পড়ে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন, এমন এক শিক্ষক তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন: ‘এই খবরটি পড়ার পর প্রথমেই আমার মনে প্রশ্ন জাগল, আমি কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়েই কি আমি দুই দফায় পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেছিলাম?’
ছাত্রলীগের যে নেতারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করলেন এবং করে যাচ্ছেন, তাঁদের সবার চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে হয়তো এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা আপাতত বেঁচে যাবেন!

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.