সংলাপ আগে, আন্দোলন পরে

৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পটভূমিতে আরেকটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন দিতে বর্তমান সরকার আগ্রহী কি না, তা খুব স্পষ্ট নয়। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য নেতারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছিলেন, এখন তা আর স্বীকার করছেন না। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা এখন ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে অন্য সুরে কথা বলছেন। কারণ, রাজনীতির কৌশলে বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছে হেরে গেছে। আওয়ামী লীগ ও সরকার তার পুরো সুবিধাটি এখন ভোগ করছে। রাজনীতিতে এ রকম হতেই পারে। এখন মার্চ মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী’ পদে মানতে চাননি। পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ফল কী হলো? আমও গেল, ছালাও গেল। এ জন্য পাকিস্তানিদের মনস্তাপ কি কখনো ঘুচবে? রাজনীতিতে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮-দলীয় জোটের অংশ না নেওয়া ভুল হয়েছিল, না ঠিক হয়েছিল, এ বিতর্ক করে এখন লাভ নেই। কারণ, পাখি উড়ে গেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচনের পর আন্দোলনের আভাস দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পারি না,
এখনই আন্দোলনের কথা আসছে কেন? আন্দোলন হলো শেষ অস্ত্র। বিএনপি যদি আগাম নির্বাচন চায়, তাহলে তো প্রথমে সরকারকে আলোচনার প্রস্তাব দেবে। আলোচনার জন্য চাপ দেবে। তখন আমরা দেখব, সরকারপক্ষ কী বলে বা কী করে। আন্তর্জাতিক মহলও দেখবে সরকারের ভূমিকা। আলোচনার প্রস্তাব দিলে সরকারকে একটা কথা তো বলতেই হবে। মন্ত্রীরা মুখে যত কথাই বলুন, সরকারও এই প্রশ্নবিদ্ধ ভোটারবিহীন নির্বাচনে ‘নির্বাচিত সরকার’ নিয়ে খুব স্বস্তিতে নেই। দেশে-বিদেশে তাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কাজেই, বিএনপি যদি আলোচনার প্রস্তাব দেয়, তাহলে সরকারের আনুষ্ঠানিক উত্তর কী হবে, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই। আলোচনার প্রস্তাব বিএনপিকেই দিতে হবে। কারণ, গরজ বিএনপির। তবে সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে তার অবস্থান পাল্টাতে হবে। বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ বলা ঠিক হবে না। অবৈধ সরকারের সঙ্গে কি আলোচনা করা যায়? বর্তমান সরকার আইনিভাবে বৈধ, কিন্তু বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। এটা দেশে-বিদেশে অনেকেই বলেছেন। এটা সরকারকে মেনে নিতে হবে। আমরা আশা করব, বিএনপি এখন আন্দোলনের কথা না বলে আলোচনার প্রস্তাব দেবে। আলোচনা ব্যর্থ হলে বা সরকার আলোচনায় আগ্রহী না হলে তা জনগণ দেখবে। তখন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ তাতে সাড়া দিতেও পারে। জনগণ যেন বুঝতে পারে, বিএনপি বাধ্য হয়ে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে।
দুই বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে: বিএনপির মধ্যে একটা সংস্কার অভিযান শুরু হয়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। তবে তার আগে কয়েকটা বিষয় বিএনপিকে ভালোভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। কারণ, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপির জন্য এটা নতুন অধ্যায়। বিএনপি যদি একটি গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকশিত হতে চায়, তাহলে কয়েকটি ব্যাপারে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। যেমন: ১. বিএনপি যে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার, তা দলের কাজে ও কথায় স্পষ্ট করতে হবে; ২. ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতৃত্ব ও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে একাত্ম হতে হবে; ৩. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর ও জামায়াতের নেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে নিন্দামুখর হতে হবে; ৪. মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সাম্য সম্পর্কে আস্থাবান হতে হবে। এগুলো ১৯৭১-এর মূল কথা, ইতিহাসের অংশ। ইতিহাসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে কিন্তু বিকৃত করার সুযোগ নেই। বিএনপিকে বুঝতে হবে, শুধু জিয়াউর রহমানের একটি ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। আর বেতারে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা ইতিহাসের একটি বড় ঘটনা। আওয়ামী লীগ একে যত ছোট করার চেষ্টাই করুক না কেন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার বহু পথ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেও আওয়ামী লীগের অপকীর্তি কম নেই। বিএনপি আওয়ামী শাসনামলের সমালোচনা করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব সব বাংলাদেশির। বিএনপি কতিপয় যুদ্ধাপরাধীর স্বার্থে সেই গৌরব হাতছাড়া করছে কেন?
জামায়াত কয়েকটি ভোট ছাড়া বিএনপিকে আর কিছু দেয়নি। বিনিময়ে বিএনপি অর্জন করেছে বহু মানুষের ধিক্কার, যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চায় না। ১৯৭১ সালে বিএনপির জন্ম হয়নি। ১৯৭১-এর ইতিহাস ও আদর্শকে স্বীকার করলে বিএনপির ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল নয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বিএনপি ও ১৯-দলীয় জোটে রয়েছেন অনেক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে মেনে নিয়েও বিএনপি ’৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা, রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন, ’৭৫ সালে বাকশাল গঠন, পরবর্তী আওয়ামী সরকার ইত্যাদির তীব্র সমালোচনা করতে পারে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমালোচনা থাকবেই। তবে তা হতে হবে তথ্যনিষ্ঠ। আজগুবি সমালোচনা কোনো ফল দেয় না। আমাদের ধারণা, বিএনপি তাদের নতুন অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে দলকে পুনর্গঠন করতে পারলে আগামী নির্বাচনে ও আন্দোলনে বিএনপি লাভবান হতে পারে। বিএনপির নেতৃত্বকে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে হবে: এ দেশের বহু লোক আওয়ামী লীগের শাসন থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু তাই বলে তারা যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, জঙ্গি, মৌলবাদী গোষ্ঠীরও শাসন চায় না। বিএনপির সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর যে কোনো মিত্রতা নেই, তা বিএনপির কথায় ও কাজে প্রমাণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার ব্যাপারে বিএনপির মধ্যে যে কোনো অস্পষ্টতা নেই, তা-ও বিএনপিকে কথায় ও কাজে প্রমাণ করতে হবে। এ দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণেরা এখন খুবই সচেতন।
তিন সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনের (যতটা হয়েছে) ফলাফল থেকে প্রমাণিত হয়, সমগ্র দেশে বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। সরকার বিএনপিকে নানাভাবে দমন করার চেষ্টা করছে। নেতাদের হয়রানি ও নির্যাতন করছে। পুলিশ ও প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সহায়ক হয়েছে। এগুলো কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগকে নিশ্চয় কোনো না কোনো সময়ে বিরোধী দলে যেতে হবে। তখন বর্তমান সরকার যা যা করছে, তার পুনরাবৃত্তি যে হবে না, তা কি কেউ বলতে পারে? সংসদে অন্য কোনো জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনো পাবে না, তা কি কেউ নিশ্চিত বলতে পারে? তখন কত কিছুরই তো পরিবর্তন হতে পারে। কাজেই সরকার বা আওয়ামী লীগ এখন যেসব অগণতান্ত্রিক আচরণ করছে, তা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। আমরা চাই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিও একটি গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত একটি বলিষ্ঠ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকশিত হোক। বিএনপি যদি একটি প্রতিক্রিয়াশীল, ডানপন্থী, জামায়াতঘেঁষা মৌলবাদী দল হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে, তাহলে বহু সচেতন মানুষের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আর বিকল্প থাকে না। বিএনপি তাদের অতীত কিছু কথা ও কাজের জন্য বহু বদনাম কুড়িয়েছে। এখন নতুন অধ্যায় শুরু করার সময় নিজেদের নানা ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেবে, এটাই অনেকের প্রত্যাশা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.