ক্ষতিপূরণ ও করণীয়

গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। বিশ্বে কোনো একক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যার বিচারে শুধু নয়, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও লোভের বিচারেও এটি ছিল অনন্য হূদয়বিদারক ঘটনা। সেদিন যে দুর্ভাগা শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ করতে ঢুকেছিলেন, তাঁরা প্রথমে সেখানে ঢুকতে চাননি। কিন্তু ভবনের মালিক ও ভেতরে অবস্থিত চারটি কারখানার মালিকদের কাছে দ্রুত অর্ডারের সাপ্লাই নিশ্চিত করাই ছিল প্রধান বিষয়। পরবর্তী সময়ে এ কথাও প্রকাশিত হয়েছে যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ দুর্ঘটনার আগে এ ভবন পরিদর্শনে এসেছিল, কিন্তু প্রতিব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ কারণেই আজ অনেকে মনে করেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’। এসব উদাসীন লোভী লোকের শাস্তি দিতে হবে এবং তাঁদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে হবে। প্রাণের বিনিময়ে মুনাফা উপার্জন চলবে না। কেউ কেউ বলতে পারেন, এই শিল্প বাংলাদেশে ৪৪ লাখ শ্রমিকের চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে, ২৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় সৃষ্টি করছে। বিশ্বের তুলা উৎপাদনকারী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারীর মর্যাদা অর্জন করেছে। সামনে রয়েছে অবারিত বিপুল সম্ভাবনা। সুতরাং এই মালিকেরা যদি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ভয়ে বিনিয়োগই বন্ধ করে দেন, তাহলে কী হবে? এ আশঙ্কা কতটুকু সত্য?
আমরা জানি, বাংলাদেশের বিদ্যমান পোশাকশিল্পের ইতিহাস কমবেশি ৩০ কি ৩৫ বছরের। এই সময়ে একটি শিল্পের এ রকম উল্কাসদৃশ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে সস্তা শ্রমসহ কতগুলো বিশেষ সুবিধা এবং নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের সুযোগ থাকার জন্য। এ কথা ঠিক, যত নিরাপত্তা আইনবলয়ই আমরা তৈরি করি না কেন, যত নিয়মকানুনই তৈরি করি না কেন, তা ফাঁকি দেওয়ার স্বাভাবিক বিষয়গত একটি প্রবণতা পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে প্রথম দিকে হয়তো থাকবে। এ কথা সহজেই অনুমেয় যে এ ধরনের প্রথম প্রজন্মের পুঁজিপতিরা পুঁজির অভাবের কারণে একবারে বিপুল বিনিয়োগে সমর্থ নয়। সুতরাং বাস্তব সমাধানটা কী হতে পারে? যাতে লাঠিও ভাঙবে না কিন্তু সাপও মরবে! আমি প্রস্তাব করছি, সরকার বর্তমানে যে উৎস কর সংগ্রহ করে পোশাকশিল্প খাত থেকে, সেটার অংশবিশেষ সেই সব মালিকের ‘ম্যাচিং গ্রান্ট’ বা ‘বিনা সুদে ঋণ’ হিসেবে প্রদান করুক, যাঁরা শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল তৈরির লক্ষ্যে বিনিয়োগ করতে সম্মত ও প্রস্তুত রয়েছেন। রানা প্লাজার ঘটনাটি সম্পূর্ণ অদ্বিতীয় ঘটনা। কিন্তু এখানকার মালিকেরাও ছিলেন ছোট বা মাঝারি স্তরের মালিক। সাব-কনট্রাক্টের মাধ্যমে তাঁরা বড় কাজ হাতে নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা তাড়াহুড়ো করেছিলেন এবং লোভ সামলাতে সক্ষম হননি। সুতরাং সেখানে এবার যে ক্ষতিপূরণের মাত্রা নির্ধারিত হয়েছে, সেটি শুধু এখানকার জন্যই প্রযোজ্য। এখানে কি কোনো ভর্তুকির প্রয়োজন রয়েছে? বিশেষত, যদি তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থের (যার পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে!) সংকুলান না হলে কী হবে?
তার পরেও আমি বলব, ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রচুর অর্থ জমা হয়েছে। তা ছাড়া আমরা শুনতে পাচ্ছি, বিদেশি ক্রেতারা বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এই দুই ধরনের অর্থ যোগ করলে ক্ষতিপূরণের যে হিসাব ক্ষতিপূরণ কমিটি নির্ধারণ করেছে, তা অনায়াসে বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে আমার মতে, যাঁরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, তাঁদের শাস্তিও হওয়া উচিত। সেটা আর্থিক হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক, তা হওয়া উচিত। তবে এটি নির্ধারণের দায়িত্ব ক্ষতিপূরণ কমিটির নয়, মহামান্য হাইকোর্টের। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে বিজিএমইএর বর্তমান নেতারা এই ক্ষতিপূরণ প্রস্তাবের বিষয়ে অস্বাভাবিক তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছেন। যেহেতু তাঁদের কোনো ব্যয়ভার বহন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশঙ্কা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ রকম দুর্ঘটনা যে ঘটবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। ক্ষতিপূরণের এই বিধান যদি হাইকোর্ট একবার গ্রহণ করে ফেলেন, তখন সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনাকবলিত কারখানার মালিকদের কাছ থেকে এই টাকা বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করা হবে—এটাই তাঁদের ভাবনা। সবিনয়ে তাঁদের বলতে চাই, প্রাণের মূল্য ১৫ লাখ টাকা মোটেও বেশি কিছু নয়। আপনারা প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী যেটা দিতে চাইছেন (মাত্র এক লাখ টাকা), তা বর্তমান বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য নয়। ২৪ বিলিয়ন ডলারের শিল্পের মালিকদের জন্য এই ক্ষতিপূরণের হার বিশ্ববাসী গ্রহণ করবে না। আপনাদের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি এতে মোটেও উজ্জ্বল হবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে এটা খাপ খায় না।
সক্ষমতা নেই, এ কথা সত্য হলেও ক্ষতিপূরণের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বিজিএমইএর অবস্থান হওয়া উচিত ছিল ক্ষতিপূরণের উৎসগুলো নিয়ে বিকল্প প্রস্তাবের অবতারণা করা। শ্রম আইনের দোহাই দিয়ে একটি অযৌক্তিক ক্ষতিপূরণের জন্য চাপাচাপি করাটা মোটেই তাঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেনি। বিকল্প প্রস্তাব কী হতে পারে, সে সম্পর্কে এই লেখার প্রথমেই আমি ইঙ্গিত দিয়েছি। তবে আবারও বলব, এই শিল্প এখন আর নাবালক শিল্প নয়। তাই স্যালাইন দিয়ে, ভর্তুকি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করার পর্যায় আমরা অতিক্রম করেছি।এখনো যদি আমরা তাকে শিশু শিল্পের মতো বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিই, তাহলে এটি কোনো দিন আর প্রাপ্তবয়স্ক হবে না। এ রকম কথা বাজারে শোনা যায়, রানা প্লাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে কোনো ব্যক্তির দোষে নয়, সেদিন হরতাল ছিল বলে হরতালকারীরা ভবন ধরে নাড়াচাড়া দেওয়ায় ওটা ঘটেছে! একজন আমাকে বলেছেন, কেউ কেউ চেয়েছিলেন যে আবহাওয়া দপ্তরকে দিয়ে একটি স্থানীয় ভূমিকম্পের গল্প ফাঁদতে। এসব প্রবণতা যখন সমাজে থাকে, খুন-হত্যা-জখম করে ক্ষমতাসীনেরা যখন টাকার জোরে পার পেয়ে যায়, তখন অসহায় শ্রমিকদের পাশে কে দাঁড়াবে? কেনই বা মানুষ ধনিকশ্রেণীকে বিশ্বাস করবে? কেনই বা মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা রাখবে? আজ ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আমরা জনগণকে একটা নতুন বার্তা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেই সুযোগ আমরা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ উজ্জ্বল করব। বিজিএমইএর ভাবমূর্তিও তাতেই উজ্জ্বল হবে, অন্য কোনোভাবে নয়।
ড. এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
akash92@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.