সহজিয়া কড়চা- বঙ্গীয় হলফনামা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

গণতন্ত্রের সঙ্গে হলফনামার কোনো সম্পর্ক আগে ছিল না। এই শব্দটিই আগে ভোটাররা শোনেননি। কেউ, যদি তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হন, তাঁর সম্পদ ও অর্থকড়ি মাসে কত গুণ বাড়বে তা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তা জানার অধিকার কারও নেই। বিশেষ করে গরিব ভোটারদের, যাঁদের দুবেলা ভাত বা রুটি জোটে না, তাঁদের জানার প্রয়োজন কী?

মানবেতিহাসের সবচেয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামার সচিত্র প্রতিবেদন কয়েক দিন যাবৎ কাগজে বেরোচ্ছে। পাঁচ বছরে কারও আয় বেড়েছে ৩৫১ গুণ। কারও ১০৭ গুণ। কারও ৬৭ গুণ। কারও বা ৪০ গুণ। কেউ পাঁচ কোটি টাকায় ৭০ একর জমি কিনেছেন। স্ত্রীর নামে শেয়ার আছে এক কোটি ২২ লাখ টাকার। এক কোটি ১৮ লাখ টাকায় দুটি গাড়িও কিনেছেন। পাঁচ বছর আগে ছিল একজনের এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা ও সাড়ে পাঁচ একর জমি। এখন ১৪৬ একর জমি ও পাঁচ কোটি টাকা। প্রার্থীদের ধর্মপত্নীরা পাঁচ বছরে ধনী হয়েছেন গ্রিক ধনকুবের ওনাসিসের স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডির চেয়ে বেশি। বিল গেটসের সম্পদ প্রতি পাঁচ বছরে কত গুণ বাড়ে তা বলতে পারব না, তবে এ হারে নিশ্চয়ই নয়।
কী হয়নি তাঁদের পাঁচটি বছরে? প্রাসাদের মতো বাড়ি, পূর্বাচল প্রভৃতিতে প্লট (নিজের ও স্ত্রীর নামে), বহু ফ্ল্যাট, কৃষিজমি, দোকান, কোম্পানির শেয়ার, ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ জলোচ্ছ্বাসের মতো ফুলে উঠেছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বহু রকম, কোটি কোটি টাকার গাড়ি, কয়েক কেজি সোনাদানা। কী নয়? গণতন্ত্র সব দেয়।
তাঁদের নিজেদের হলফনামার সংবাদ কাগজে পড়ে অনেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছেন। এতে বেইজ্জতির কিছু নেই। গৌরবের কথা। হলফনামায় আছে অর্থ-সম্পদের অংশমাত্র। এত বোকা তাঁরা নন। বরং দেশবাসীকে বোকা বানিয়ে দিয়েছেন। খবর পড়ে বিচলিত শাশুড়ি ফোন করেন। হলফনামাওয়ালা বলেন, মা/আম্মা, কিচ্ছু ভাববেন না। এ তো আমার আর আপনার মেয়ের সম্পদের পাঁচ-সাত ভাগের এক ভাগ। বাকি আমার আর আপনার মেয়ের নামে-বেনামে আছে। তা ছাড়া হলফ তো করেছি দেশের ভেতরের সম্পদের। দেশের বাইরে বাড়ি, ফ্ল্যাট, ডলার, ইউরো, পাউন্ড স্টার্লিং যা আছে, তা আলাদা।
‘তা বাবা, না হয় আর একটু কমাইয়া দিতা’, শাশুড়ি মায়ের উদ্বেগ যায় না।
‘আপনি বুঝবেন না। এটা না দিয়া উপায় ছিল না। ভবিষ্যতে ওই এগারো-টেগারোর মতো যদি কোনো বালা-মুসিবত আসে, এই হলফ কাজে লাগব। দুদক বেকায়দায় ফেলতে পারব না। ওই কাজ সাইরা রাখলাম।’
বাংলাদেশি গণতন্ত্র রাষ্ট্রের চার মূলনীতি ও চেতনা বাস্তবায়নের গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্র হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র। সর্বোপরি সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। ক্ষমতার পাঁচ বছরেই এসএসসি পাস মাননীয় কী করে এত সম্পদ গড়লেন, তা তাঁর প্রতিবেশীদেরও তাজ্জব করেছে। তাঁরা বলেন, ‘একটা সাইকেল কেনার আর্থিক সংগতি ছিল না’ পাঁচ বছর আগে, তিনি ‘এখন রাজার হালে তিনটা গাড়িতে চড়েন।’ সকালে যে গাড়িতে বাজারে যান, দুপুরে পার্টি অফিসে সেটায় যান না। স্ত্রী ওটা নিয়ে যান বাপের বাড়ি। সন্ধ্যায় জেলা সদরে যান অন্য গাড়িতে।
অবশ্য মাননীয় নিজে দাবি করেছেন, ‘জেলার ছয় এমপির মধ্যে আমি খুবই ভালো লোক।’ সে কথা তো সত্যজিৎ রায়ের পিতৃদেবই বলে গেছেন: ‘এ দুনিয়ায় সকল ভালো/ আসল ভালো/ নকল ভালো/...কিন্তু সবার চাইতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুড়।’ [সুকুমার রায়] ভোটাররা তিনখানা পাজেরোর চেয়ে তিন পিস পাউরুটি আর এক বাটি ঝোলা গুড় দিনের শেষে পেলেই খুশি।
এই হলফনামার ঝামেলাটা বাধিয়েছে নাগরিক সমাজ। আগে এসব ছিল না। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে নির্বাচন কমিশনে দেওয়ার নির্দেশ উচ্চতর আদালত থেকে দেওয়া হয়েছে। তথ্যের মধ্যে সার্টিফিকেটসহ শিক্ষাগত যোগ্যতা, কত মামলার খুনখারাবির আসামি, পেশা, আয়ের উৎস প্রভৃতি। এই তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি সরকার চায়নি। প্রধান দল দুটি করেছে তীব্র বিরোধিতা। নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য দেওয়ার বিধান চালু করতে অন্যান্য ব্যক্তি ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার কোর্টের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করে জুতার সুকতলি ক্ষয় করেছেন।
শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেন দৃঢ় অবস্থান না নিলে হলফনামা বাংলাদেশে চালু হতো না। ভোটাররাও জানতেন না তাঁদের নেতারা রকফেলার, ফোর্ড, টাটা, বিড়লা বা বিল গেটসের চেয়ে কম প্রতিভাবান নন। ২০০৫ সালে সুনামগঞ্জের এক উপনির্বাচনে প্রথম হলফনামা দাখিল করা হয়। সে এক বিরাট কাহিনি।
প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য যাতে মিডিয়ায় প্রকাশিত না হয়, তার জন্য নানা ফন্দি আমাদের পরিপূর্ণ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এঁটেছিল। কিন্তু সম্প্রতি তথ্য অধিকার কমিশন গণমাধ্যমকে তথ্য দিতে তাদের কড়া নির্দেশ দিয়েছে। আদালতের নির্দেশ তো আছেই। তবে আলামত যা দেখছি তাতে হলফনামার তথ্য যাতে প্রকাশ না হয় তার জন্য ‘হলফনামা প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে উঠতে দেরি নেই। হবে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন। নীল পতাকা মিছিল। গণ-অনশন পর্যন্ত। আমাদের অতি নিরপেক্ষ দুদক কর্মকর্তারাও প্রার্থীদের সম্পদের উৎস সন্ধানে আগ্রহী নন। তাতে নাকি অপূর্ব নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ওপর সরকারি নেতারা নাখোশ। টক শোর ওপর মহা ক্ষিপ্ত। পুরোনোদের বাদ দিয়ে নতুন নতুন চেতনাপন্থীদের ঢোকানোর সুপারিশ হচ্ছে। যদিও আমরা হলফনামা থেকেই দেখতে পাচ্ছি অনেক মহাজোট নেতার টক শো থেকেও আয়টা কম নয়।
এভাবে পাহাড়, ফসলি জমি, বনভূমি— দেশের সব সম্পদ হলফনামাওয়ালাদের হাতে চলে যেতে থাকলে আর মাত্র দুটি নির্বাচনের প্রয়োজন হবে। এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুধু বাংলা ভাষাটা বাঙালির মুখে থাকবে, তার পায়ের তলায় পলিমাটির বাংলাদেশটা থাকবে না। একাত্তরের শহীদ ও জনগণের ভাগ্যের কী সুন্দর পরিহাস— স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে সম্পদের চেতনা।
দেশে দেশে উগ্র মাওবাদী আন্দোলন অকারণে হচ্ছে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

2 comments:

Powered by Blogger.