দশম জাতীয় সংসদ- যে নির্বাচনে সবাই হারবে by এম সাখাওয়াত হোসেন

বিরোধী জোটের বর্জন আর সহিংস অবরোধের মধ্য দিয়েই সরকারি জোট আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচনের শেষাঙ্ক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। মোট ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ১২টি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।
এই জোটের মধ্যে শাসক দল আওয়ামী লীগ ছাড়া আছে আরেকটি বৃহত্তর দল জাতীয় পার্টি। কিন্তু দলটির মহাডিগবাজি আর বিভাজনের কারণে ক্ষমতাসীন মহলে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় রাখতে যেসব কাণ্ড দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে, তাও দেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অধ্যায় হয়ে থাকবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাতীয় পার্টি ছাড়া সরকারের সঙ্গে যে দলগুলো রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ এককভাবে ৫০ থেকে ১০০ প্রার্থী দিতে পারেনি। উপরন্তু সবাই নিজের দলের মার্কা বিসর্জন দিয়ে নৌকা নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছে। তবে সিংহভাগকেই ভোটারদের কষ্ট দিতে হয়নি। একতরফা জয়যুক্ত হয়েছেন।

সংসদের ৩০০ আসনে যেখানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হওয়ার কথা, তার মধ্যে ১৫৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তার মানে বর্তমানে দেশের নয় কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে চার কোটি ৮৩ লাখ ভোটারের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। শতকরা হিসাবে মোট ভোটারের ৫২ ভাগ ভোটার ভোট প্রদান থেকে বঞ্চিত রইলেন। অপরদিকে নির্ধারিত দিনে শতকরা ৪৮ ভাগ ভোটার ১৪৬ জন প্রার্থীকে ভোট দিলে দিতেও পারেন। পরিসংখ্যানমতে ভোট প্রদানে বাকি রয়েছেন প্রায় চার কোটি ৪৬ লাখ ভোটার। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাদ দিলে বাকি আটটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৭৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং ষষ্ঠসহ নয়টি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোট ছিল গড়ে ৬৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। কাজেই তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক যে আসন্ন নির্বাচনে বাকি সব ভোটার ভোট দিলেও গড়পড়তা হার এর চেয়ে কম হবে। ১৯৯৬-এর ভোটারবিহীন নির্বাচনের বোঝা এখন সরকারি দলের ঘাড়ে চেপেছে।
বিরোধী দলের বর্জনের এবং অবরোধের মুখেও প্রাথমিক পরিকল্পনায় সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগ এই আসন্ন নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোটার সমাগমের আশায় চেষ্টা চালাচ্ছিল। অনেক নেতা বলেছেন, নির্বাচন বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না, তা নিয়ে তাঁরা মোটেও চিন্তিত নন, জনগণের অংশগ্রহণে দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই যথেষ্ট। কিন্তু সরকারের সে প্রচেষ্টা হোঁচট খেয়েছে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায়। এ কারণে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার কণ্ঠে পরিষ্কার হতাশার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
৫ জানুয়ারির প্রাক্-নির্বাচনের চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এমন পরিস্থিতির জন্য সরকারি দল বা জোট মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কাজেই বাকি আসনের নির্বাচনের ফলাফল বা সমষ্টিগত ফলাফল কতখানি গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে বা হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সরকারি দল এবং নির্বাচন কমিশন উৎকণ্ঠিত। ইতিমধ্যে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না।
অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে। ফলে তাদের সহযোগী স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংগঠনগুলোও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
বিদেশি বা দেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির প্রয়োজন হয় আমাদের মতো দেশে, যেখানে গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক এবং ভোটের প্রক্রিয়ার সংস্কৃতি উন্নত নয়। অধিকতর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফলাফলও পরাজিত দল বা প্রার্থীরা বিতর্কিত করতে সচেষ্ট থাকেন। উদাহরণ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইইউ, ইউএন, কমনওয়েলথ, আনফ্রেল এবং দক্ষিণ এশিয়ার পর্যবেক্ষক দল ছাড়াও প্রায় দেড় লাখ স্থানীয় পর্যবেক্ষক উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচনের পর পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ আনলেও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা এ দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন। যে কারণে বিরোধী দলও এ বিষয়টিকে জোরালোভাবে উত্থাপন করতে পারেনি। তা ছাড়া ২০০৮ সালের নির্বাচন মডেল হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভাগ্য এখনই নির্ধারিত হয়ে আছে। বিশেষ করে, যখন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত পরিণতির আগেই ১১তম সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের মনোভাব কেমন হতে পারে, তা অনুমেয়। সরকারি দল থেকে বলা হচ্ছে, যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাই সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণেই এই নির্বাচনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ওপরে আলোচিত প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে ১৫৪ জন প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেসরকারিভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি জোট ও নির্বাচন কমিশনের সব উদ্যোগের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে। এমনটা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কোনো অঙ্কেই হয়তো ছিল না। কেন এমন হলো, তা জোটের স্বার্থেই সরকারি জোট ও বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগকে নিরূপণ করতে হবে। কারণ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের সব আন্দোলনের পুরোধা এই দলের ইতিহাসে এই নির্বাচন কালোতম অধ্যায় বলে লিপিবদ্ধ হবে। একই সূত্রে স্বাধীন দেশের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসেও এই অধ্যায় নেতিবাচক উদাহরণ হয়ে থাকবে।
যা-ই হোক, এই নির্বাচনে অবশ্যম্ভাবী জয় হবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের। জয় হবে যাঁরা আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। যদিও ইতিমধ্যে ৫২ শতাংশ জয়ী হয়েই আছেন। সরকারও গঠিত হবে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির বিরোধী দলও থাকবে; তবে কত দিন এই সরকার ক্ষমতায় থাকবে, কতখানি কার্যকর হবে, বর্তমান বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ কোন পথে গড়াবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সরকার কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়। তবে এ কথা ঠিক, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত কিছু লোক লাভবান হলেও সমষ্টিগতভাবে খেসারত দিতে হবে অনেক সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং সার্বিকভাবে দেশের রাজনীতিকে। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দল ব্যক্তিগত নয়, জনগণের প্রতিষ্ঠান।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে এখনই ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু হয়েছে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো। দেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের ক্ষতির পরিমাণ যে বেশি হবে, তা তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছে। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হবে বিরোধী জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও। গীতা সেন নামের এক সাধারণ গৃহবধূ যে ‘অসুস্থ সরকার ও অসুস্থ রজনীতির’ কথা বলেছেন, তা মানুষের মনে গ্রথিত হয়ে আছে। জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে রাজনীতিবিদদের ওপর। দেশের রাজনীতির সংস্কৃতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এটি লজ্জাজনকও বটে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন। এমনিতেই এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর জনগণের আস্থা কম ছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যাও কিছুটা ভাবমূর্তি উদ্ধার হয়েছিল, তাও এখন ভূলুণ্ঠিত। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যার হাত দিয়ে গণতন্ত্রের শক্ত ভিত রচিত হওয়ার কথা, সেই প্রতিষ্ঠানটি এখন সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। বিশেষ করে, ১৫৪ জন প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এবং এর নেপথ্যের বহু ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর জনমনে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার বক্তব্য পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও তাদের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড জনগণকে হতাশ করেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হবে নির্বাচন-প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রধান নিয়ামক ভোটারদের নির্বাচনের ওপর আস্থা। তাঁদের সামনে রয়েছে নবম সংসদ নির্বাচনের একটি স্পষ্ট ক্যানভাস, যার নিরিখে তুলনা হবে এই নির্বাচন। নির্বাচনব্যবস্থায় ভবিষ্যতে আস্থা ফেরাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
সবশেষে আন্দোলনের নামে যে নাশকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, তার জন্য বিরোধী জোটকেও মাশুল দিতে হবে অনেক দিন। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা। অনেকে কী কারণে প্রাণ দিয়েছেন, তাও জানতে পারেননি। বহু মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় থাকবেন। কিসের স্বার্থে কার স্বার্থে, এর জবাব হয়তো কোনো দিন কেউ পাবেন না। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। সর্বোপরি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতির জের চলবে অনেক দিন, মাস, বছর। উপসংহারে বলতে হয়, এই নির্বাচনে কারও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জিতেও হারবে ক্ষমতাসীন জোট। হারবে বাংলাদেশ।
এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.