একুশ শতকে এক অবাস্তবতা by সাযযাদ কাদির

সমঝোতা ভাল, সমঝোতার জন্য সংলাপ-ও ভাল, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না তাতে। অন্তত আমাদের দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে এ ধরনের উদ্যোগের সাফল্য পাওয়ার তেমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। তাহলে কি আছে আমাদের সামনে?
বিরোধী পক্ষের আরও আন্দোলনের চেষ্টা, সরকারের আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, আন্দোলনের ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসা, একতরফা নির্বাচন, আবার সরকার গঠন। এ রূপরেখা বা দৃশ্যকল্প সকলের জানা। দেশের ও বিদেশের সকলের। তাদের অনেকে চাইছেন এমনটাই ঘটুক, তবে বেশির ভাগেরই তা মনঃপূত নয়। সরকার ও তার সমর্থকরা চাইছেন, কারণ তাঁদের আশঙ্কা এভাবে নির্বাচন হলেই কেবল তাঁদের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব। এজন্যই ক্ষমতার জোর তাঁরা খাটাতে চাইছেন সবখানে। আর ওই যে যাঁদের মনঃপূত নয় এমন দৃশ্যকল্প তাঁরা আসলে সব ধরনের সিনাজুরির বিরুদ্ধে। তাঁরা বলছেন সমঝোতা, সংলাপ ইত্যাদি। কিন্তু ভবী কি ভোলে এতে? তাহলে বিজয়ের ৪২ বছর পর কি দাঁড়ালো আমাদের অর্জন? জাতীয়তা হয়েছে বিভাজিত, ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এখন বিদ্বেষজর্জরিত সহিংসা, সমাজতন্ত্র কবেই সমাজচ্যুত, গণতন্ত্র দলিত মথিত নিষ্পেষিত। এ অবস্থাকে বিরোধীরা বলছেন ‘স্বৈরাচার’। এ দেশের পরিস্থিতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, সাবেক মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশ সম্ভবত হতে যাচ্ছে একটি ‘একদলীয় রাষ্ট্র’। সমালোচকেরা আরও একটু বাড়িয়ে বলছেন ‘একব্যক্তিয় রাষ্ট্র’। আমাদের জন্য অবশ্য নতুন কিছু নয় বিষয়টি। সেই আইয়ুব খান যা শুরু করেছিলেন তা আর শেষ হলো কই? একজনের পর একজন তো আসছেনই। এরশাদ নিজেই স্বীকার করেছিলেন, তাঁর শাসন-ব্যবস্থাটা আসলে ‘ওয়ান ম্যান শো’। আশির দশকে এক সম্পাদকীয় আলোচনার সূত্রে ‘সংবাদ’-সম্পাদক আহমদুল কবির বলেছিলেন, ‘পিছিয়ে পড়া দেশে একব্যক্তিয় শাসনই ভাল। এতে দ্রুত বাস্তবায়নের সুযোগ থাকে পরিকল্পনা ও কর্মোদ্যোগের। তবে আমাদের দরকার বেনেভোলেন্ট ডিকটেটর (সদাশয় একনায়ক)।’ কিন্তু সে অমাবস্যার চাঁদ কোথায় মিলবে? বিশেষ করে এখনকার এই ঘোর অমাবস্যায়? এখন যে অবস্থা এর একটা বিশ্বস্ত বিবরণ এই বিজয়ের মাসে, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে গত ১০ই ডিসেম্বর এক মানবাধিকার রিপোর্টে দিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। পড়তে পড়তে শিউরে ওঠার মতো সে রিপোর্ট। আমাদের তো দেখতে-দেখতে গা-সহা হয়েছে সব, কিন্তু সচেতন বিশ্ব শিউরে উঠবে নিশ্চয়ই। ওই রিপোর্ট থেকে সংক্ষিপ্ত কিছু উদ্ধৃত করি এখানে:
... The country seems to have turned into an open prison for ordinary citizens. The social, economic, academic, and spiritual life of Bangladeshis is under extreme threat. Any person walking out onto the street literally takes their life in their own hands; the possibility of a bomb going off or bullets flying is real. Arson attacks on public transports are a daily occurrence, killing and maiming innumerable commuters and bystanders. Across the country, the clash is ongoing between agents of the state– accompanied by goons of the ruling party– and opposition protestors. This violence, which victimizes so many who have nothing to do with the political power game, and does not even spare law-enforcement personnel, serves as grist to the mill of Bangladeshi ‘democracy’. ... Through the year, and over the decades, the institutions of Bangladesh have been weakened so a nexus can be maintained for the rulers. In the process citizens are denied their rights. Gross abuse of human rights in Bangladesh are mostly related to quest for, and maintenance of, power, which guarantees the ruling segment ‘licence’ to corruption and impunity. ...”
একুশ শতকের বিশ্বে এমন একটি রাষ্ট্র আসলেই ঘোরতর এক অবাস্তব, কিন্তু এ এক কঠিন সত্য-ও বটে। কেন এমন হতে পেরেছে? খুঁজে দেখলে কারণ অনেক, কিন্তু মোদ্দা বিষয় তিনটি: ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বিবাদ-বিরোধ, রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চাহীনতা, দুর্বল নির্বাচন কমিশন এবং এক ঝুড়িতে ভারতের সব ডিম রাখার নীতি। বাংলার মানুষ অতীতে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে সব চ্যালেঞ্জ, এই চারটি চ্যালেঞ্জ-ও যে খুব বেশি দিন টিকবে না- তা জোর দিয়েই বলতে পারি।

sazzadqadir@rediffmail.com

No comments

Powered by Blogger.