নির্বাচনী সংকট- স্থায়ী সাংবিধানিক সমাধানে কিছু প্রস্তাব by মঈন ফিরোজী

নির্বাচনপদ্ধতি স্থায়ী ব্যবস্থায় রূপ নেবে, যদি সাংবিধানিকভাবে একটি গ্রহণযোগ্য কার্যকর নির্বাচন কমিশন এবং এর আইনি প্রায়োগিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস এবং নির্বাচনকালে রাষ্ট্রক্ষমতার অপপ্রয়োগের সুযোগ রোধ এবং উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়।
এ জন্য সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদ এবং নির্বাচনী আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজন করা আবশ্যক।

নির্বাচন কমিশন গঠন: নতুন বিধান করতে হবে যে, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি প্রয়োগে ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না। এর মানে কমিশনার নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা থাকবে না। সংবিধান সংশোধনের সাত কার্যদিবসের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে নিয়োগকৃত কমিশনের কার্যকাল শেষ হওয়ার ষাট দিন আগে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সরকারি ও বিরোধী দল নিজ নিজ দলীয় সদস্যের বাইরে, সংবিধান-নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন সম্মানিত নাগরিকদের মধ্য থেকে, প্রত্যেকে ২০ জন করে দুটি তালিকা স্পিকারের মাধ্যমে একে অপরকে প্রদান করবেন।

উভয় তালিকায় কারও নাম অভিন্ন হলে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। তবে একাধিক নাম অভিন্ন হলে রাষ্ট্রপতি তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

তালিকাপ্রাপ্তির সাত কার্যদিবসের মধ্যে সরকারি দল বিরোধী দলের এবং বিরোধী দল সরকারি দলের প্রদত্ত তালিকা থেকে যৌথভাবে মিল পাওয়া যায়নি এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বাধ্যতামূলকভাবে দুজনের নাম গ্রহণ করে স্পিকারের কাছে লিখিতভাবে জমা দেবেন।

স্পিকার উভয় পক্ষের গৃহীত নামসংবলিত পত্রপ্রাপ্তির পর তা মূল তালিকাসহ অভিন্ন নাম এবং উভয় পক্ষের গৃহীত নামের পত্র অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন।

রাষ্ট্রপতি স্পিকারের কাছ থেকে পত্রপ্রাপ্তির পর অনতিবিলম্বে যৌথভাবে মিল পাওয়া ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং গৃহীত চারজনকে কমিশনার হিসেবে শপথ পাঠ করাবেন।

উভয় পক্ষের প্রদত্ত তালিকায় অভিন্ন নাম না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে একক এখতিয়ারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের যেকোনো একজন বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

যদি কোনো পক্ষ, সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তালিকা প্রদানে বিরত থাকে বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি অন্য প্রাপ্ত তালিকা থেকে চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারবেন। একইভাবে কোনো পক্ষ যদি অপর পক্ষের প্রাপ্ত তালিকা থেকে কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত থাকে বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি ওই তালিকা থেকে দুজনকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারবেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ মেয়াদপূর্তির আগে শূন্য হলে জাতীয় সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দল উক্ত পদ শূন্য হওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে ঐকমত্যে যৌথভাবে একটি নাম স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন এবং রাষ্ট্রপতি অনতিবিলম্বে তাঁকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে শপথ পাঠ করাবেন। উভয় পক্ষ সাত কার্যদিবসের মধ্যে যৌথভাবে একটি নাম নির্ধারণে ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে একক এখতিয়ারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের যেকোনো একজন বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

অন্য নির্বাচন কমিশনারদের পদ মেয়াদপূর্তির আগে শূন্য হলে, বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার যে পক্ষের তালিকা থেকে মনোনীত হয়েছিলেন, সে পক্ষ পুনরায় উক্ত পদ শূন্য হওয়ায় সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে নিজ দলীয় সদস্যের বাইরে, সংবিধান-নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন সম্মানিত নাগরিকদের মধ্য থেকে ১০ জনের নামের তালিকা স্পিকারের মাধ্যমে অপর পক্ষের কাছে প্রেরণ করবেন এবং অপর পক্ষ উক্ত তালিকা থেকে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে বাধ্যতামূলকভাবে একটি নাম গ্রহণ করে স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন এবং রাষ্ট্রপতি ওই নামপ্রাপ্তির পর অনতিবিলম্বে তাঁকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে শপথ পাঠ করাবেন।

শূন্য পদে মনোনীত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।

নির্বাচনকালীন নির্বাহী ক্ষমতা: সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৫(১) ও (২) ধারা অনুসারে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে। কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সহায়তা না করলে বাস্তবে নির্বাচন কমিশনের সংবিধান এবং নির্বাচনী আইন অনুসারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।

উপরন্তু সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হয়। ফলে নির্বাচনকালীন সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যথানিয়মে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা দুরূহ হতে পারে।

অতএব, নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর করতে এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বের ভারসাম্য আনতে নির্বাচনকালীন নির্বাহী ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজনে সংবিধান ও নির্বাচনী আইনের নিম্নলিখিত সংশোধন বাঞ্ছনীয়।

(১) সরকারি দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি পক্ষ হওয়ায়, তার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার নিয়ামক কোনোভাবেই নির্বাচনে সমতা আনয়নে সহায়ক নয়। তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৫(২)-এ নিম্নোক্ত সংযুক্তি দেওয়া যেতে পারে।

‘নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হতে সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়া পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হবে।’

(২) প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বা তাঁর কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হওয়ায় সাধারণ নির্বাচনকালীন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করার প্রয়োজন পড়বে না এবং তা সমীচীনও হবে না। অতএব সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর
থেকে সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে না মর্মে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যেতে পারে।

(৩) সাধারণ নির্বাচনকালীন নির্বাহী কর্তৃপক্ষের মধ্যে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত কিংবা সুষ্ঠু করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনকে দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে রাষ্ট্রপতির অধীনে ন্যস্ত করতে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সংযুক্তি আনা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতির অধীনে ন্যস্ত করলেও নির্বাচন কমিশনের উক্ত দুই মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ নিম্নলিখিত সংযোজন করা যেতে পারে।

(ক) সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়া পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেকোনো প্রশাসনিক নিয়োগ, বদলি, প্রেষণে প্রেরণ, পদায়ন, পদ থেকে অপসারণ বা অব্যাহতির প্রয়োজন বোধ করলে নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবেন। রাষ্ট্রপতি অন্যূন তিন কার্যদিবসে উক্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নের অনুমোদন দেবেন, নতুবা তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর বলে গণ্য হবে। অন্য সব মন্ত্রণালয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠান ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে।

(খ) রাষ্ট্রপতি সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়া পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেকোনো প্রশাসনিক নিয়োগ, বদলি, প্রেষণে প্রেরণ, পদায়ন, পদ থেকে অপসারণ বা অব্যাহতির প্রয়োজন বোধ করলে তিনি নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তাব দেবেন। নির্বাচন কমিশন তিন কার্যদিবসে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে এবং তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অন্য সব মন্ত্রণালয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠান ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে।

মঈন ফিরোজী: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.