সরকারকে আলোকিত আত্মস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে by ড. মাহবুব উল্লাহ্

তিন-চার সপ্তাহ আগে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে টেলিভিশন টকশোতে জ্ঞানী-গুণীজনরা বলতেন, দেশ অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে এগিয়ে চলেছে। কী ঘটবে বা কী ঘটতে পারে সেই সম্পর্কে স্পষ্ট করে কেউ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। অনেকে হতাশার সুরে বলেছেন, টানেলের শেষে কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, তারা আশাবাদী। বাংলাদেশে এ ধরনের সংকট অতীতেও সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। আমি নিজে প্রথম আলোতে কয়েক মাস আগে লিখেছিলাম, আমরা এক গভীর গিরিখাতের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখান থেকে কোনো রকমে পা ফসকালে গিরিখাতের গভীর তলদেশে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। কিন্তু তখন কেউই এতে কর্ণপাত করেনি। সংকট গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা বারবার সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি সমঝোতায় উপনীত হতে বিবদমান পক্ষগুলোকে উৎসাহিত করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। টেলিফোন করেছেন। তার বিশেষ দূত হিসেবে সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো দু’বার বাংলাদেশে এসেছেন। প্রথমবার তিনি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সংক্ষিপ্ত সফর শেষে নিউইয়র্কে ফেরত গেছেন। দ্বিতীয়বার তিনি অধিকতর প্রস্তুতি নিয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ যাত্রায় তিনি বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে বহুবার কথা বলেছেন। এক পক্ষের সঙ্গে মিটিং শেষ করে অন্য পক্ষের কাছে ছুটে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দু’পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আনতে সক্ষম হন। দুই দফা বৈঠকও হয়। দু’পক্ষের বৈঠকে গতিসঞ্চারের জন্য তিনি তার সফর একদিন বর্ধিত করেন। বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলন করে বৈঠকের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি কিছু কথা বলেন। বৈঠকে কী কথা হয়েছে সেটা স্পষ্ট না করলেও তিনি আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জাতিসংঘ কী কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চায়, সেটাও তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মিস্টার তারানকো দুটি প্রণিধানযোগ্য উক্তি করেন। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, যদি আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে কী কী হবে বা হতে পারে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, কী হতে পারে, সেটা আপনারা ভালো করেই বোঝেন। তার দ্বিতীয় মন্তব্যটি ছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যম সম্পর্কে। তিনি গণমাধ্যমকে ভারসাম্যপূর্ণ ও পক্ষপাতমুক্ত আচরণ করার আহ্বান জানান। তার এ শেষ মন্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারসাম্যপূর্ণ ও পক্ষপাতমুক্ত আচরণের প্রশ্নটি তখনই উঠতে পারে যখন আচরণ হয় ভারসাম্যহীন ও পক্ষপাতদুষ্ট। একজন ভিনদেশী বোদ্ধা ও বিশেষজ্ঞ যখন এরকম মন্তব্য করেন, তখন গণমাধ্যমের দায়িত্ব হয়ে পড়ে গভীর আÍজিজ্ঞাসা ও আÍবিক্ষণে নিয়োজিত হওয়া। কিন্তু সে কাজটি কতটুকু করা হয়েছে, সেটা গণমাধ্যমের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ ভালো করে বলতে পারবেন।
তারানকোর উপস্থিতিতে দুই দফা বৈঠকের পর তৃতীয় দফায় আরেকটি বৈঠক হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তার কাছে দেয়া প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী তৃতীয় বৈঠকটি হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো ফলোদয় হয়নি। সরকার পক্ষ তার লক্ষ্য অনুযায়ী দশম সংসদ নির্বাচনের পক্ষে আছে। অপরদিকে ১৮ দলীয় জোট এই নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের আন্দোলনে আছে। এ মুহূর্তেও অবরোধ চলছে। অবরোধের ফলে এরই মধ্যে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যা বড়ই মর্মান্তিক! এদেশে একটা সময় ছিল যখন একটি কিংবা দুটি মৃত্যু ক্ষমতাসীনদের ভিত কাঁপিয়ে দিত। এখন শত মৃত্যুতেও তেমন কিছু আসে যায় না। আমরা যেন অনুভূতিহীন হয়ে নিঃসাড় হয়ে পড়েছি। একসময় বঙ্গদেশে একটি প্রবচন প্রচলিত ছিল। প্রবচনটি হল, মরা ছেলে নিয়ে কান্না করে লাভ নেই। আসলে তখন শিশু মৃত্যুহার এত বেশি ছিল যে, সন্তানের মৃত্যু নিয়ে শোক না করার পরামর্শ দেয়া হতো। মধ্যযুগের ইউরোপেও এমন একটি পরিস্থিতি ছিল। তখন সন্তানের মৃত্যুতে মায়েরা কদাচিতই শোকাশ্র“ বর্ষণ করত। কারণ একই, শিশু মৃত্যুর উচ্চহার। এমন মৃত্যুকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নেয়া হতো। বাংলাদেশ-উত্তরকালে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘাতে জীবননাশের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু সেই তুলনায় জনপ্রতিক্রিয়ার ধার ক্রমশ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। আমরা মর্মান্তিক কিংবা লোমহর্ষক ঘটনায় নির্বিকার থাকছি। নিজে বেঁচে থাকতে পারলেই স্বস্তিতে থাকি, অন্যদের যত বড় সর্বনাশই হোক না কেন। এ ধরনের জনমনস্তত্ত্ব অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ মানসিকতার সুযোগেই অত্যাচারী শাসকরা দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও সমাজে ফ্যাসিবাদ শেকড় গেড়ে বসে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী অবলোকন করে সে রকম কিছু মনে করা অযৌক্তিক নয়।
এবারকার অবরোধ আন্দোলনে যে বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেটি হল রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলের পার্থক্য। যারা গ্রামাঞ্চল সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছ থেকে শুনেছি, এমনকি গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছেন এমন মানুষদের কাছ থেকেও শুনেছি যে, গ্রামাঞ্চলে বিরোধী দলের আন্দোলনে জনসম্পৃক্তি অত্যন্ত প্রবল। এ বিভাজনের ব্যাখ্যা কী? প্রথমত, রাষ্ট্রের নিপীড়ন যন্ত্র ঢাকায় অত্যন্ত প্রবল, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে ততটা নয়। দ্বিতীয়ত, ঢাকার নাগরিকরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক সুবিধা ভোগ করে, যা গ্রামের মানুষ করে না। অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর সুবিধাপ্রাপ্ত ঢাকাবাসী কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ তাতে করে তাদের বিত্ত ও সম্পদহানির আশংকা থাকে। তৃতীয়ত, গ্রামাঞ্চলের মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে শাসক দলের অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়নের ভুক্তভোগী হয়েছে, সে রকম অভিজ্ঞতা ঢাকাবাসীর হয়নি। ছোটবেলায় জর্জ এলিয়টের লেখা উপন্যাস ‘Silas Marner’ পড়েছিলাম। সেই উপন্যাসে insect-like existence-এর কথা জেনেছিলাম। অর্থাৎ সুড়ঙ্গের মধ্যে কীট যেভাবে তার অস্তিত্ব বজায় রাখে। আমরা ঢাকাবাসী সে রকম বিচ্ছিন্ন জীবনে অভ্যস্ত। প্রতিবেশীর কী হল তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমাদের জীবনে যৌথভাবে বাঁচার চাহিদা বলতে গেলে অনুপস্থিত। আমরা দিনে দিনে আত্মসর্বস্ব হয়ে পড়ছি। এ অবস্থায় কোনো collective action-এ আমরা নামতে চাই না। এসব কারণে ঢাকা শাসকগোষ্ঠীর জন্য অনেকটাই নিরাপদ। তার মানে এই নয় যে, ঢাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শাসকগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন করে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারাও শাসকগোষ্ঠীকে প্রত্যাখ্যান করবে।
তৃতীয় দফা সংলাপের পর আর কোনো সংলাপ হয়নি। হবে বলেও মনে হয় না। এরই মধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এরকম ঘটনা অতীতে এদেশে বা অন্য কোনো দেশে ঘটেনি যাতে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ভোটার তাদের পছন্দ ব্যক্ত করতে পারেনি। বিরোধী দলের আন্দোলনে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন করার মুরোদ নেই। যেমন মুরোদ আমরা লক্ষ্য করেছি ’৯৬ সালে এবং ২০০৭ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলোর অসহযোগ ও লগি-বৈঠার আন্দোলনে। এখন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল সহিংসতার। বর্তমান আন্দোলনে সহিংসতা একটি বড় উপাদান। কিন্তু কেন এ অনাকাক্সিক্ষত সহিংসতা ঘটছে, সে কথা শাসক দল ও গণমাধ্যম বলছে না। নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করার ফলেই যে দুর্ভাগ্যজনক সহিংসতার উদ্ভব ঘটেছে সে কথাটি স্বীকার না করলে অর্ধসত্য বলা হয়।
যা হোক, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ডামাডোলের মধ্য দিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু কত শতাংশ লোক সত্যিকার অর্থে ভোট দিতে যাবে সেটি বড় ধরনের প্রশ্ন। এরই মধ্যে বিদেশীরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রদূতরা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। সাভারের স্মৃতিসৌধে তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেননি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিনিধি পাঠানো হবে না বলে তারা জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কবুল করেছেন এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটি সুখকর নয়। এখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপার নিয়ে কথা হতে পারে, তবে শর্ত হল বিএনপিকে সহিংসতা ত্যাগ করতে হবে এবং জামায়াতকে ছাড়তে হবে। বাস্তবতা হল, দশম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে সেটি ভয়ানক বৈধতার সংকটে পড়বে। নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রবলভাবে প্রশ্ন উঠবে। যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা ব্যাপারটি কত গভীরভাবে উপলব্ধি করেন সেটাই প্রশ্ন। তারা যদি সংকটের ভয়াবহতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা চিন্তা করে সুমতিতে আসেন তাহলে দেশটি বেঁচে যায়। শুধু একটি বিদেশী শক্তির সহায়তার ভরসায় তারা যদি একগুঁয়েমির পথ বেছে নেন, তাহলে দেশের মানুষের ক্ষতি যেমন আরও বাড়বে, তাদেরও অনেক ক্ষতি হবে। তাই তাদেরও আলোকিত আÍস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা ভালো করেই জানেন সেই সিদ্ধান্তটি কী। তাদের একজন মন্ত্রী এরই মধ্যে আরও পাঁচ বছর চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু এরকম ভয়াবহ ইঙ্গিত কারও জন্যই মঙ্গলকর হবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.