আওয়ামী লীগ জিতলেও হারবে না দেশ

 চলতি সপ্তাহে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট লিখেছে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলেও হারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো একটা দেশ, যার রয়েছে গণতন্ত্রের দীর্ঘ ঐতিহ্য, সেই দেশটি এত সহজে হেরে যাবে? হারলে হারবে আওয়ামী লীগই, দেশ হারবে কেন? এটা তো পরিষ্কার যে আওয়ামী লীগ জিতলেও রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে হারবে সেই দলটিই। জিতবে একতরফা নির্বাচনে কিন্তু হারবে নিজেদের বিবেকের কাছে। কারণ, তারা এমন একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছে, যেখানে অন্য কোনো দল নেই। এমনকি জনধিক্কৃত যে এরশাদের ওপর ভরসা করে আওয়ামী লীগ অগ্রসর হচ্ছিল, বেগতিক দেখে তিনিও সময়মতো সটকে পড়েছেন। ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী জিতে গেছেন। বাদবাকি আসনেও তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। সুতরাং ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ নিঃসঙ্গ। এখানেই তাদের পরাজয়। জিতেও হারবে সেই দলটিই, বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগ বলতে পারে, এ রকম তারা চায়নি। বিএনপির জন্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন করতে হচ্ছে। কারণ, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য জামায়াত নির্বাচনে যাবে না, আর জামায়াত যাবে না বলে বিএনপিও নির্বাচনে যাবে না।
এই যুক্তি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাওয়া যাবে না। নিজেদের আশ্বস্ত করা যেতে পারে, কিন্তু মানুষের চোখে তা টিকবে না। মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, বিচারের রায় কার্যকর হোক, সেটাও চায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে প্রধান বিরোধী দলসহ অন্য সব দলকে বাদ দিয়ে একা নির্বাচন করতে হবে। এর পরিণাম তাদের দলের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে। দেশের পরাজয়ের প্রশ্ন এখানে ওঠে না। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। এরপর অনেক দুর্যোগ গিয়েছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর দীর্ঘ ১৬ বছর সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা পার হতে হয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে, সে অপরাজেয়। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, ২০ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি ছোট্ট খবর বেরোয়। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা প্রেসক্লাবে এক যৌথ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন যে রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ কাউকে বাধা দেবে না। সেই বৈঠকে জামায়াতের কোনো নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম বিএনপির বন্ধুদের অনুরোধ জানান, সহিংসতা রোধ ও শান্তি বজায় রাখার জন্য তাঁরা যেন জামায়াতের সঙ্গে মিলে কোনো কর্মসূচিতে না যান।
অন্যদিকে, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম জানান, দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘাত নেই, কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল হানাহানি লাগাতে চায়। তিনি এ ব্যাপারে নজর রাখা এবং একে অন্যের কর্মসূচির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানান। এ খবরটি আরও দু-তিনটি পত্রিকায় এসেছে। প্রথম আলোর গাইবান্ধা প্রতিনিধির সঙ্গে গত সোমবার কথা বলে জানা গেছে, ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার খান ও বিএনপির নেতা স্বপন একসঙ্গে মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন। এ সময় জামালপুর ইউনিয়নের কাছে একদল দুর্বৃত্ত তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনার পরই পরিস্থিতির উদ্বেগজনক দিকগুলো দুই পক্ষের আলোচনায় আসে। দুই দলের স্থানীয় নেতারা অন্তত সহিংসতা রোধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। যদি অবরোধের নামে নাশকতা, রেললাইন তুলে ফেলে সাধারণ যাত্রীদের জীবন বিপন্ন করা, বাসে-সিএনজিতে পেট্রলবোমা মেরে নিরীহ চালক-যাত্রীদের হত্যা করা চলতে থাকে, তাহলে দেশের আরও অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের পথ ধরবেন। এটাই বাংলাদেশের শক্তি। এ জন্যই প্রথম আলো বলছে, এত সহিংসতা-সংশয়ের মধ্যেও পথ হারাবে না বাংলাদেশ। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা বিএনপির অবরোধ-আন্দোলনের সুযোগে কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন চালাচ্ছেন। রগকাটা, গলাকাটার পাশাপাশি এখন তাঁরা ‘জলবায়ু-দস্যু’ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। সাতক্ষীরা, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কের দুই ধারের অন্তত এক লাখ গাছ কেটে তাঁরা রাস্তা অবরোধ করছেন। স্থানীয় থানা-পুলিশ নাকি অসহায়। খবর জানলেও কিছু করতে পারে না।
কারণ, তাদের নাকি লোকবলের অভাব। এই গাছগুলো সামাজিক বনায়ন উদ্যোগের ফসল। বহু বছরের চেষ্টায় ও স্থানীয় জনসাধারণের যত্নে গাছগুলো বড় হয়ে উঠছিল। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রোধের জন্য এসব কর্মসূচি বিশ্বে সমাদৃত হচ্ছিল। সবুজ গাছ যারা ধ্বংস করে, তারা শুধু দেশের শত্রু নয়, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি কাজ, কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উদ্যোগেরও শত্রু। এটা বোঝার ক্ষমতাও জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন থাইল্যান্ডেও হচ্ছে। কিন্তু সেখানে এভাবে মানুষ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মারা হয় না। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা সংসদে বিল এনে তাঁর ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে দুবাইয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে অবস্থানরত থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে সব মামলা ও প্রদত্ত শাস্তি মাফ করে ‘ক্ষমা’ ঘোষণা করলে বিরোধীরা আন্দোলন শুরু করে। এমন আন্দোলন যে প্রধানমন্ত্রী ইংলাক একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বিরোধী আন্দোলন সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় দখল করে তাদের দপ্তর বানায়! এ অবস্থায়ও প্রধানমন্ত্রী ইংলাক বিক্ষোভ দমনে বল প্রয়োগের পথে যাননি। পরে তিনি সংসদ বিলুপ্ত করে আগামী ২ ফেব্রুয়ারি মধ্যবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিরোধীরা সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা জানায়, প্রধানমন্ত্রী ইংলাকের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, তাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। একটি অনির্বাচিত ‘পিপলস কাউন্সিল’-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
অবস্থাটা অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। এ সম্পর্কে পূর্বোক্ত দি ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক সংকট: ডেডলক’। সেখানে বিরোধী ডেমোক্রেটিকের এক জ্যেষ্ঠ নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে’ তাঁরা নির্বাচন বাদ দিয়ে চলতে পারেন না (দি ইকোনমিস্ট, ১৪ ডিসেম্বর)! ওই একই সংখ্যায় চিঠিপত্র কলামে ব্যাংককের মনসন মারুকাতাতের একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করছেন, ক্ষমতাসীনেরা ‘ক্ষমা’ ঘোষণার বিল অনুমোদনে অনেক অনিয়ম করেছে, গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ভোর চারটায় বিল পাস করিয়েছে। বিরোধী দলের কোনো কথা শুনতে রাজি হয়নি। এ জন্যই মানুষ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। সম্প্রতি বিরোধী আন্দোলনের নেতা সুথেপ তাঁর নেতৃত্বে কার্যত একটি বিকল্প সরকার গঠনের জন্য সব সরকারি কর্মকর্তার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। হয়তো আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেবে না। ২০০৬ সালেও এই দলটি নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু এত সব কাণ্ডের জন্য কি এ কথা বলা যাবে যে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে ইংলাক জিতবে আর থাইল্যান্ড দেশটি হেরে যাবে? এ রকম কোনো কথা কিন্তু দি ইকোনমিস্টও বলেনি।
থাইল্যান্ডের আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের অনেক কিছু শেখার আছে। সেখানে এত বড় আন্দোলনে ব্যক্তিগত খুনোখুনি, বাস-গাড়ি ভাঙচুর, আগুন-ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়নি। আবার বিরোধীরা সরকারি কার্যালয়ের ভবন দখল করে নিলেও সরকার কিন্তু পাইকারি হারে গুলি, রাবার বুলেট, জেল-জুলুম চালায়নি। পুলিশের গুলিতে দু-তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। এর বেশি কিছু নয়। অথচ আমাদের দেশে নির্বিচারে গুলি, বিরোধী দলের নেতা-কর্মী হাজারে হাজারে গ্রেপ্তার, তাঁদের কার্যালয় ঘেরাও করে কার্যত বন্ধ করে রাখার মতো ঘটনা চলছে। গণতন্ত্রের জন্য এগুলো মোটেও শুভ নয়। এখন আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে, নির্বাচনে জিতলেও, রাজনৈতিক ও নৈতিক পরাজয় তারা ঠেকাবে কীভাবে। এখানে বিকল্প খুব কমই অবশিষ্ট আছে। এখনো যদি দুই পক্ষের মধ্যে একধরনের সমঝোতা করে, নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে হয়তো শেষরক্ষা হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এখন একযোগে বলতে হবে, যা হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। এখন একসঙ্গে বসে সবাই মিলে নির্বাচনের একটা পথ বের করাই সবচেয়ে জরুরি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.