জামায়াতের কাছে বিএনপির আত্মসমর্পণ?

কাদের মোল্লার ফাঁসির পর রাস্তায়
গাড়ি পোড়ায় জামায়াত-শিবির
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি হয় গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা এক মিনিটে। কিন্তু আগের দিন থেকেই জামায়াত-শিবির তাণ্ডব চালাতে থাকে। পরদিন শুক্রবার বিরোধী জোট বা দলের কর্মসূচি ছিল না। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রলয় ঘটে যায়। গণমাধ্যম সাক্ষ্য দিচ্ছে: ‘গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডবে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া নোয়াখালী, পিরোজপুর ও যশোরে সহিংসতায় তিনজন মারা গেছেন। এ ছাড়া গতকাল রাতে খুলনা মহানগরের নিরালা পুলিশ ফাঁড়িতে শিবিরের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক আখ ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। ‘রাজধানীর মতিঝিলে এজিবি কলোনি ও মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকায় গতকাল শুক্রবার ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাঁরা প্রাইভেট কার, বাস, কাভার্ড ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ ১৫টি যানবাহন ও ২০টি ফুটপাতের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছেন। (ইত্তেফাক, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩) ‘কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে জামায়াত-শিবিরের লোকজন তাঁর (সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুর আলম) বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি কোনোমতে প্রাণ বাঁচান।’ (প্রথম আলো, ১৮ ডিসেম্বর) তবে নির্দলীয় সরকারের দাবির সঙ্গে এসব ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি এক নয়।
বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। আর জামায়াতে ইসলামী ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। জামায়াতি হুকুমত কায়েম হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব থাকে না। আবার বিএনপি যে উদার গণতন্ত্রের কথা বলে, সেটি চালু হলে মৌলবাদী জামায়াতের ঠাঁই হওয়ার কথা নয়। ধর্মতন্ত্র ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে না। কিন্তু বাংলাদেশের নিয়তি হলো, ২০১৩ সাল বিএনপি ও জামায়াতকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিএনপির নেতাদের দাবি, তাঁরা আন্দোলন করছেন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির যে আন্দোলন করছে, তার প্রতি তাঁদের সমর্থন নেই। কিন্তু বাস্তবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে। দুটি রাজনৈতিক দল তখনই অভিন্ন রণকৌশল নেয়, যখন তাদের উদ্দেশ্য এক হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে বিএনপি ও জামায়াতের উদ্দেশ্য এক নয়। জামায়াতের উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধাপরাধের বিচারে অভিযুক্ত বা দণ্ডিত নেতাদের রক্ষা করা। এ জন্য তারা দেশব্যাপী সহিংসতা চালাচ্ছে, গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ মারছে, রেলের ফিশপ্লেট তুলে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এসব ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী?
তারা কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, নাকি বিপক্ষে? নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা ছিল—সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যতটা সম্ভব দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অথবা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করা। বিএনপি প্রথমটি গ্রহণ করেনি এই ভীতি থেকে যে, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গেলে সরকার ফল উল্টে দেবে। দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নমনীয় হলেও ‘শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়’ নীতিতে অবিচল থাকেন খালেদা জিয়া। ফলে বিএনপির সামনে দ্বিতীয় পথ খোলা থাকে। অর্থাৎ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করা। যেমনটি আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে করেছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ সব দল থেকে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল। এবার বিএনপি পারেনি জামায়াতের কারণে। ডা. বি চৌধুরী, অলি আহমদ, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ নির্দলীয় সরকারের দাবির প্রতি শতভাগ একমত থাকলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যাননি জামায়াতের কারণে। বিএনপির নেতৃত্ব পুরোনো সুহূদদের চেয়ে জামায়াতের প্রতিই বেশি ভরসা রাখে। কেননা সরকারকে মোকাবিলা করার মতো তাদের কর্মী-ক্যাডার নেই, কিন্তু জামায়াতের আছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রথম জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা রাজধানীতে বড় ধরনের ভাঙচুর ও সহিংসতা ঘটায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকলেও ‘প্রবাসী নেতৃত্ব’ সবই জানতেন। গত ফেব্রুয়ারিতে কাদের মোল্লার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়। এরপর জামায়াত-শিবির আন্দোলনের নামে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা, সরকারি স্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। সাঈদীর রায়ের পর সেই হিংসা ও নাশকতা ব্যাপক আকার নেয়।
চাঁদে সাঈদীর ছবি দেখার গুজব তুলে সারা দেশে তারা তাণ্ডব চালায়। এরপর বিএনপির নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন এবং জামায়াত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী তৎপরতা কখনো সমান্তরাল, কখনো একে অপরের পরিপূরক হিসেবে চলতে থাকে। জামায়াত-শিবির ভালো করেই জানে, পেছনে বিএনপি না থাকলে মাঠে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আবার বিএনপির নেতৃত্বও মনে করেন, জামায়াত-শিবিরের সমর্থন ছাড়া রাজপথ দখলে রাখা যাবে না। এই অবস্থায় নির্বাচনী রাজনীতি পেছনে ফেলে যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী রাজনীতি সামনে চলে আসে। বিএনপির নেতৃত্বও ‘কম পরিশ্রমে বেশি ফসল’ ঘরে তোলার কৌশল নেন; যা এখন বুমেরাং হয়ে পড়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক সমর্থনের জোরে জামায়াত-শিবির চোরাগোপ্তা হামলা ও সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে সরকারি প্রশাসন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। গত এক মাসের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ১৮ দলের নামে কর্মসূচি দেয় বিএনপি, পালন করে মূলত জামায়াত-শিবির। ঢাকাসহ সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই মিছিল-সমাবেশ-বৃক্ষনিধন ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমনকি নোয়াখালী, বগুড়া, রাজশাহীর মতো স্থানে যেখানে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী, সেখানেও মিছিল-সমাবেশ হয় জামায়াতের নেতৃত্বে।
কাদের মোল্লার ফাঁসির আগে ও পরে সারা দেশে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ ও মানুষ হত্যার মাধ্যমে আন্দোলনকে পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলটির উদারপন্থী নেতারা জামায়াত-শিবিরের কাছে এই আত্মসমর্পণ মেনে নিতে পারেননি। প্রকাশ্য ফোরামে না হলেও ব্যক্তিগত আলাপে তাঁরা ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত বলেও মনে করেন বিএনপির এই অংশের নেতারা। তাঁদের কথা হলো, আমরা এমন একজন ব্যক্তির জন্য কেন বদনাম নেব, যাঁকে পাকিস্তান তাদের আদর্শিক নেতা বলে দাবি করে। বিএনপিতে এখনো অনেক নেতা-কর্মী আছেন, যাঁরা নির্দলীয় রাজপথে জামায়াতের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়াকে মানতে পারছেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের আন্দোলনে জনগণের সমর্থন পেতে হলে জামায়াতের সঙ্গে বর্তমানে যে গাঁটছড়া রয়েছে, সেটির অবসান হওয়া প্রয়োজন। উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তাই, বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য আন্দোলনের নামে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তারা। এর দায় কেন বিএনপি নেবে? হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে সরকারবিরোধী অনেকেই খুশি হবেন। তবে এটিও সত্য যে, এতে বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ না করার জন্য সরকারের প্রতি যেমন আহ্বান জানানো হয়েছে, তেমনি আন্দোলনকারীদের প্রতিও সহিংসতা পরিহার করতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এশিয়াবিষয়ক পরিচালক অ্যাডামস বলেছেন, ‘জামায়াতের সমর্থকেরা পুলিশ ফাঁড়ি,
সরকারি ভবন, সরকারি দলের সমর্থক এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী ও বিরোধী দলগুলোর হয়তো বিক্ষোভ করার সংগত কারণ আছে। কিন্তু তাদের সমর্থকেরা যে ধরনের ভয়ংকর সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে, এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৬ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০ দিনে নিহত হয়েছেন ১০৫ জন। এর মধ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ১৮ দলের হরতাল-অবরোধে মারা গেছেন ৭৫ জন এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৩০ জন। টানা অবরোধ ও হরতালের মধ্যে কাদের মোল্লার ফাঁসির খবর প্রচারিত হওয়ার পর (যদিও ওই দিন ফাঁসি হয়নি) মঙ্গলবার রাত থেকে ঢাকার বাইরে তাণ্ডব শুরু করে জামায়াত-শিবির। বিচারপতির বাড়ি, সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, রেললাইন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর—কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিএনপির নেতৃত্ব কি জামায়াত-শিবিরের এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞও নির্দলীয় সরকারের আন্দোলনের অংশ বলে মনে করেন? যদি না করেন, তাহলে এখনই তাদের পরিষ্কার করে বলতে হবে। পরিষ্কার করতে হবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রস্তাব সম্পর্কেও তাদের অবস্থান। পথ হারাবে না বাংলাদেশ দেশের দুঃসময়ে রাজনীতিকেরাই যে পথ দেখাতে পারেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের কণ্ঠে।
সাদুল্যাপুর প্রেসক্লাবে দুই দলের নেতারা বৃহস্পতিবার একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁরা শান্তির লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করবেন এবং উপজেলায় কাউকে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা করতে দেবেন না। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবেন, কেউ বাধা দেবেন না। তাঁরা বলেন, উপজেলার রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বহুকাল ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকলেও সম্প্রতি মহলবিশেষের উসকানিতে তা ব্যাহত হয়। তাঁরাও এটিও স্বীকার করেন যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; স্বার্থান্বেষী মহল এই বিরোধ তৈরি করে রেখেছে এবং সবাইকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। তবে এই শান্তি সমাবেশে সাদুল্যাপুরের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন নেতারা উপস্থিত থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর কাউকে ডাকা হয়নি। উল্লেখ্য, ১৩ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার খানের ওপর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা হামলা চালালে তিনি গুরুতর আহত হন। এর কয়েক দিন পর আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা বিএনপির নেতা মইনুল হাসান সাদিকের বাড়িতে আগুন দেন। এ রকম আগুনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্যই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা শান্তি বৈঠক করেছেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে এ রকম একটি শান্তি বৈঠক কি হতে পারে না?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.