এটা কি লোকসভা নির্বাচনের পূর্বাভাস? by শরীফ হাসান

নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে গত ৪ ডিসেম্বর শেষ হয় ভারতের দিল্লি, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মিজোরাম ও মধ্যপ্রদেশের বিধানসভার নির্বাচন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠেয় লোকসভার নির্বাচনের আগে এসব রাজ্যের নির্বাচন ছিল সেমিফাইনাল পর্ব। যার চারটিতে হেরেছে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান দল কংগ্রেস। দীর্ঘ ১৫ বছর পর দিল্লি হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। তবে দিল্লিতে এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। বেশি আসন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পেলেও সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পায়নি। এর কারণ, চমক দেখিয়েছে আনকোরা দল আম আদমি পার্টি (এএপি)। এখন তারা বলছে, সরকার গঠন করবে না এবং সরকার গঠনে কাউকে সমর্থনও দেবে না। এ অবস্থায় দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি শাসন অবধারিত হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার গঠিত না হলে লেফটেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সুপারিশ করেন। আর আগামী মে মাসে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে আবার দিল্লি বিধানসভার ভোট হবে। যা হোক, দিল্লি এখন ভারতীয় রাজনীতির আলোচনায় থাকলেও ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা কংগ্রেসের ভরাডুবি। দিল্লি ও রাজস্থানের বিধানসভা ছিল কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে। এ দুটিতে চরমভাবে হেরেছে তারা। অন্যদিকে ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে আগে থেকেই ক্ষমতায় থাকা বিজেপি বিজয়ী হয়েছে। মিজোরামে জিতেছে কংগ্রেস। তবে জাতীয় রাজনীতিতে রাজ্য হিসেবে মিজোরামের প্রভাব তেমন নেই।
কংগ্রেসের এই ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধানে নেমেছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। সামনে আসছে দুর্নীতি, সম্পদের অসামঞ্জস্যতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দলীয় কোন্দল ও নারীর নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা ইস্যু। তবে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। এ ছাড়া বড় উদাহরণ তো দিল্লিতে ‘জায়ান্ট কিলার’ এএপি’র উত্থান। গান্ধীবাদী আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকেই এ পার্টির উত্থান। এতদিন দিল্লিতে বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে মুখোমুখি লড়াই হয়ে এসেছে। ভোটাররা এই দুটি দলের বাইরে অন্য কারও দিকে কখনও সমর্থন দেয়নি। কিন্তু এবার ফল ও পরিস্থিতি দুটিই সম্পূর্ণ ভিন্ন। একেবারে আনকোরা দল এএপিকে জনতা ভোট দিয়েছে। এখন স্পষ্ট হয়েছে, গত বছর দিল্লিতে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে কেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ সংহতি জানিয়েছিল। ভারতীয়রা আসলে দুর্নীতিকে আর প্রশ্রয় দিতে চাইছে না। আর এ অবস্থার সুযোগ ভালোভাবেই নিয়েছেন হাজারের ভাবশিষ্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
বস্তুত কেজরিওয়ালের উত্থান ও কংগ্রেস-বিজেপির হোঁচট খাওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন হাওয়ার স্পষ্ট আভাস ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোটা দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারের কারণে কফিনে ঢুকতে বসেছিল। বলা হচ্ছে, কেজরিওয়াল কফিনে পেরেক ঠোকা ঠেকিয়েছেন। আম আদমি পার্টির উত্থান থেকে ভারতের বাকি দলগুলো যদি শিক্ষা নেয়, তবে কফিন থেকে বেরোতে পারে ভারতীয় গণতন্ত্র। কিন্তু ব্যর্থ হলে সব বরবাদ হবে।
প্রকৌশলী থেকে কর কর্মকর্তা বনে যাওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়াল চাকরি ছেড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেছিলেন অনেক আগেই। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের দাবিতে লড়েছেন তিনি ও তার সাথীরা। সফল হয়েছেন। পরে আন্না হাজারের সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নামলেন। কিন্তু জনগণের সঙ্গে থাকতে থাকতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার বন্ধুরা বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে জয় প্রায় অসম্ভব।
আন্না গররাজি হলেও রাজনৈতিক মঞ্চ দাঁড় করান কেজরিওয়াল। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বরে আম আদমি পার্টি গঠন করেন। শুরু করেন আন্দোলন-সংগ্রাম। একসময় আম আদমি পার্টির আন্দোলন-বিক্ষোভেই মূর্ত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আক্ষেপ। ফলে বাড়তে থাকে জনসমর্থন।
কেজরিওয়াল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছিল কংগ্রেস, বিজেপি ও অন্য দলগুলো। তারা ভেবেছিল, আপদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান বা কোনো আদর্শের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ না থাকা এসব দলের রাজনীতিকরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, আম আদমি এভাবে তাদের নাকে ঝামা ঘসে দেবে।
অনেক বিশ্লেষকের অভিমত, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (ইউপিএ) টানা দুই মেয়াদে ভারতের শাসনক্ষমতায় রয়েছে। এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ভালোই বিপাকে পড়ে কংগ্রেস। এর মধ্যে রয়েছে কমনওয়েলথ গেমস, থ্রিজির লাইসেন্স বরাদ্দ ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে কয়লার খনি বরাদ্দে দুর্নীতি। এর সঙ্গে ছিল সুশাসনের অভাব। এসব বিষয় সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। বিধানসভা নির্বাচনে হয়তো তারই ফল পেয়েছে দলটি।
কংগ্রেসের এই নাজুক পরিস্থিতিতে দেশটির ১১ সংসদ সদস্যের ঘুষ গ্রহণের দৃশ্য ফাঁস হয়েছে। এ সংসদ সদস্যদের ঘুষ চাওয়া এবং ঘুষ গ্রহণের দৃশ্য ধারণ করে তা ফাঁস করে দিয়েছে দেশটির সংবাদভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল কোবরা পোস্ট। যদিও এর মধ্যে কংগ্রেসের এমপি ছাড়াও বিজেপি, এআইএডিএমকে, সংযুক্ত জনতা দল ও বহুজন সমাজ পার্টির নেতাও রয়েছেন। এ ঘটনা কংগ্রেসসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছে। এদিকে হঠাৎ করেই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসভায় দুর্নীতিবিরোধী লোকপাল বিল পেশ করেছে। হট্টগোলের মধ্যে এ বিল পেশ হলেও সমাজবাদী পার্টি ও বিজেপির আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন পায়। এমনকি নিুকক্ষ লোকসভাতেও বিলটি পাস হয়। মহারাষ্ট্রে নিজের গ্রামে আন্না হাজারে নতুন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশনে বসায় কংগ্রেস তড়িঘড়ি লোকপাল বিল পেশে আগ্রহী হয়েছে।
অনেকেই বলছেন, গত দুই বছরে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ সরকারের ভাবমূর্তি বিশেষ করে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। চার রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনের পর তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে কংগ্রেস। সে কারণেই তড়িঘড়ি করে এ বিল পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছে কংগ্রেস। তবে এখন দেখার বিষয় হল আগামী পাঁচ মাসে দুর্নীতি দমনে কতটুকু সফল হতে পারে তারা। কতটুকু ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।
দিল্লির মতোই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনও কংগ্রেস আর বিজেপির দ্বিমুখী ডুয়েল হবে না। নরেন্দ্র মোদি নাকি রাহুল গান্ধী- লোকসভা নির্বাচন শুধু এ প্রশ্নের ফয়সালা করার জন্যই অনুষ্ঠিত হবে না। বরং অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে তৃতীয় শক্তিগুলো, বিভিন্ন আঞ্চলিক দল। কংগ্রেসবিরোধী হাওয়া নিঃসন্দেহে বইছে, কিন্তু সেটা শুধু বিজেপির পালেই লাগবে না। বরং নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে ফের উগ্র হিন্দুত্ববাদের জমানায় ফেরত গিয়

No comments

Powered by Blogger.