প্রধানমন্ত্রী পদের সর্বাত্মক ক্ষমতা গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায় নয় কি? by ইকতেদার আহমেদ

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও অসাংবিধানিক ইতিহাসের ৪২ বছরে তিনবার রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সংবিধান প্রণয়ন অবধি রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা সরকার পরিচালিত হতো। এ সরকারটিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বলা যায়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণয়ন করা হলে সে তারিখ থেকে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী প্রবর্তন পর্যন্ত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ পর্যন্ত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী প্রবর্তন অবধি অব্যাহত থাকে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী-পরবর্তী আবার যে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, তা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান এবং তার মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সরকারের কাছে দায়ী থাকে। অপরদিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরকারপ্রধান এবং কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে তার জবাবদিহিতা না থাকলেও সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে তিনি অভিশংসনযোগ্য।
আমাদের রাষ্ট্রীয় ৪টি নীতির একটি হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা। ১৯৪৭ সালে ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও পরবর্তীকালে দেখা গেল দু’যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পুনঃবিভাজিত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে।
আমাদের ৭২’র সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৫(১), ৫৬(১), (২), (৩), (৪) ও (৫) এবং ৫৭ (৩), ৫৮(৪) ও (৫)-এর বিধানাবলীর সঙ্গে অনুচ্ছেদ নং ৭০-এর বিধানাবলী অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, দল ও সরকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব যেন সুসংহত থাকে এবং একটি সরকারের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী বা পূর্ববর্তী নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে আগের সরকারের আদলে তিনিই যেন সরকারপ্রধান থাকেন- সেসব বিষয় মাথায় রেখে সুকৌশলে সব বিষয়ের ওপর তার সর্বাত্মক ক্ষমতা প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছিল। এ বিষয়টির ওপর স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হলে ৭২’র সংবিধানে উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলোয় কী ব্যক্ত করা হয়েছিল তা আলোচনা করা আবশ্যক।
৭২’র সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৫(১)-এ বলা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করবেন, সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ে এ মন্ত্রিসভা গঠিত হবে।
৭২’র সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৬(১), (২), (৩), (৪) ও (৫)-এ পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা ছিল- ১. একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করবেন, সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকবেন। ২. প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ সদস্য না হলে এ অনুচ্ছেদের (৪) দফা সাপেক্ষে কোনো ব্যক্তি অনুরূপ নিয়োগ লাভের যোগ্য হবে না। ৩. যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। ৪. মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হওয়ার সময় কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য না থাকলে যদি তিনি অনুরূপ নিয়োগের তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে সংসদ সদস্য নির্বাচিত না হন, তাহলে তিনি মন্ত্রী থাকবেন না। ৫. সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এ অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগদানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, এ দফার উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তারা সদস্যরূপে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে।
৭২’র সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৭(৩)-এ বলা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকতে এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করবে না।
৭২’র সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৫৮(৪) ও (৫)-এ বলা ছিল, (৪) প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবেন; তবে এ পরিচ্ছেদের বিধানাবলী সাপেক্ষে তাদের উত্তরাধিকারীরা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। (৫) এ অনুচ্ছেদে ‘মন্ত্রী’ বলতে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত।
সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা হলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাবিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৫৮-তে বিবৃত বিষয়াবলী ক্ষমতার পালাবদলের কারণে একীভূত আকারে ৫৮নং অনুচ্ছেদে স্থান পায়। ৫৮নং অনুচ্ছেদটি ৭টি দফা সমন্বয়ে গঠিত ছিল এবং এ অনুচ্ছেদে পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা ছিল- ১. রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করার এবং পরামর্শদানের জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ থাকবে। ২. পরিষদ বা মন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দান করেছেন কি-না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ দান করেছেন, কোনো আদালত সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না। ৩. রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি যেরূপ আবশ্যক মনে করবেন সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, কোনো প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পরিষদের সদস্য হবেন না। ৪. রাষ্ট্রপতি পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতিত্ব করতে নির্দেশ দিতে পারবেন। ৫. মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। ৬. রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে কোনো মন্ত্রী স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবেন। ৭. এ অনুচ্ছেদে ‘মন্ত্রী’ বলতে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭৫ সালে দুঃখজনক ঘটনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটে এবং ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ওঠ দ্বারা মন্ত্রী পরিষদ সংক্রান্ত ৫৮নং অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপনপূর্বক দফা (১) ও (৩) সংশোধন করে নতুনভাবে একটি দফা সংযোজন করা হয়।
পরবর্তীকালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা হলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা সংক্রান্ত ৭২’র সংবিধানের বিধান অক্ষুণœ রেখে অনুচ্ছেদ নং ৫৬ থেকে দফা (৪) অবলুপ্ত করায় একই অনুচ্ছেদের দফা (৫) এর স্থলাভিষিক্ত হয়।
৭২’র সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এ সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অন্যসব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হলে অনুচ্ছেদ নং ৪৮-এর দফা (৩)-এর বিধানটি অবলুপ্ত করা হয়। পরবর্তীকালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে ৪৮নং অনুচ্ছেদের (৩) দফা সংশোধিত আকারে সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়, এ সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অন্যসব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দান করেছেন কি-না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ দান করেছেন, কোনো আদালত সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।
৭২’র সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি (ক) ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে, তবে তিনি সে কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন না। অতঃপর ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭০নং অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনপূর্বক ব্যাখ্যা সংযোজন করে বলা হয়, যদি কোনো সংসদ সদস্য যে দল তাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করেছে, সে দলের নির্দেশ অমান্য করে (ক) সংসদে উপস্থিতি থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন অথবা (খ) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি ওই দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবে। তাছাড়া মূল ৭০ অনুচ্ছেদ থেকে ‘তবে তিনি সে কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন না’ এ বাক্যটি অবলুপ্ত করা হয়। এরপর দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা হলে ৭০নং অনুচ্ছেদে (২) ও (৩)- এ দুটি দফা সংযোজন করা হয়, যদিও পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী ৭০নং অনুচ্ছেদ ৭২’র সংবিধান যেরূপে বর্ণিত ছিল সেরূপে প্রতিস্থাপিত হয়।
উপরোল্লিখিত ধারাগুলোর সংশোধন ও প্রতিস্থাপনের পর বর্তমানে সংবিধানের যে অবস্থান তা পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ, মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন, সরকারের সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদে পদায়ন প্রভৃতি কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় একক সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদের বিধানাবলীর কারণে কোনো সংসদ সদস্যের প্রধানমন্ত্রী ও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে সরকার ও দলীয়প্রধান হওয়ার কারণে দলের কোন সদস্যকে কী পদ দেয়া হবে, সংসদ নির্বাচনে কারা মনোনয়ন পাবেন, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে কারা নিয়োগ পাবেন, সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কারা মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং কারা সংসদে দলের চিফ হুইপ বা হুইপ নির্বাচিত হবেন- এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
সরকারের সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাংবিধানিক এবং সামরিক-বেসামরিক সব উচ্চপদে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষায় নিয়োগ কার্য সমাধা করা হচ্ছে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে এ সংক্রান্ত মামলাটি বিচারাধীন থাকাবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলসহ আটজন অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) সাতজন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাছাড়া সুশীল সমাজের যারা সংসদীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন, তাদের প্রায় শতভাগ এবং সংসদীয় কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার কাছে অপর সবার অভিমত বা মতামত পরাভূত হয়েছে।
পৃথিবীর অপর সব সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও জ্যেষ্ঠদের পদায়ন করা হয়। কিন্তু একটি বিশেষ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব পদে এবং একটি সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায় যথাক্রমে দুই শতাধিকের কাছাকাছি এবং দুই শতাধিক সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে যথাযথ কারণ ছাড়া সার্বিক বিবেচনায় নিকৃষ্ট দু’জন কর্মকর্তাকে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের নিয়োগের কারণে সুশাসন যে বিঘিœত হয় এবং বিভাগীয় শৃংখলা যে বিনষ্ট হয়, তা দেশবাসী এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে। এ ধরনের হাজারও খারাপ নজির রয়েছে। কিন্তু নিবন্ধের কলেবরের ব্যাপ্তি বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক হিসেবে শুধু দুটি বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরা হল। এ দুটির সুবিধাভোগী দু’জন রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের একটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় তাদের এ বেআইনি ও অবৈধ নিয়োগ দেশের সচেতন জনমানুষকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে।
বর্তমান সরকারের সময় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে দলীয় সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে যে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় ঘটছে, তা অনুধাবন করার পরও পদ হারানোর ভয়ে দলের সবাই যেন এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অতিথি আপ্যায়নে ব্যয়ের কোনো নিয়মনীতি অনুসৃত না হওয়ায় আপ্যায়ন ব্যয়ভার ফি-বছর অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে। এ ব্যাপারেও যেন কথা বলার কেউ নেই।
প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান এক ব্যক্তি হলে যে কোনো সামরিক স্বৈরাচার বা একনায়ক থেকে অধিক স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সংবিধান এবং দল অনুসৃত বিধিবিধান সে সুযোগ করে দিয়েছে। সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করা হলেও ক্ষমতার আধিক্যে তার একনায়ক হিসেবে আবির্ভাব অনিবার্য। আর তাই আমরা যদি প্রকৃতই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকি এবং গণতান্ত্রিক শাসনের অনুশীলন চাই; তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান দ্বারা সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় সরকারের সর্বোচ্চ পদধারীর ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা- যার মধ্যে নিহিত আছে গণতন্ত্রের বিকাশ ও সুশাসন।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.