আশ্বিন গেল কার্তিক গেল এলো অগ্রহায়ণ- পেঁয়াজের ফুল তুমি ফুটবে কখন? by মোকাম্মেল হোসেন

প্রাতঃভ্রমণ শেষে বাসায় ফিরেছি। হঠাৎ কানে এলো-
: ধুরউ- ছাতার মাথা!
লবণ বেগমের গলা। বার বার তাড়ানোর পরও ত্যাদড় কোনো মাছি ঘুরেফিরে নাকের উপর বসলে, বজ্জাত কোনো মশা বিরামহীনভাবে পিঁ-পিঁ সুরে কানের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইলে অথবা নাছোড়বান্দা মানবশিশু কোনো বায়না নিয়ে ক্রমাগত উঁ-উঁ সুরে ভেঁপু বাজালে মানুষ বিরক্ত হয়ে থাপ্পড় দিতে পারে। আবার শব্দের মাধ্যমেও বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। কাজেই আমাকে বুঝতে হবে- ছাতার মাথা মানে হেড অব আমব্রেলা নয়। এটি একটি বিরক্তিসূচক শব্দ। সকালবেলাই কী যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে লবণ বেগম এ কথা উচ্চারণ করল, দেখার জন্য পাশের ঘরে গেলাম। দেখলাম- সে উপুড় হয়ে পুরনো পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করছে। নির্দিষ্ট কোনো তারিখের পত্রিকা খুঁজে না পেয়ে তার মুখে এ শব্দ উচ্চারিত হয়েছে ভেবে বললাম-
: কোন তারিখের পত্রিকা খুঁজতেছ- আমারে বল, আমি বাইর কইরা দিতেছি।
লবণ বেগম সরু চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল-
: তারিখ ধইরা পত্রিকা খুঁজতেছি, এই কথা তোমারে কে বলল?
- তাইলে কী বিষয়ে বিরক্ত হইছ?
: তোমার সংসারে বিরক্ত হওয়ার মতো বিষয়ের অভাব নাই। কয়টার কথা বলব?
- প্রেজেন্ট মোমেন্টে কী লইয়া বিরক্ত হইছ- সেইটা বল।
লবণ বেগম কথা বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করতেই খাবার টেবিল থেকে কলরব ভেসে এলো।
চ্যানেল পাল্টিয়ে ওখান থেকেই ধমকের সুরে লবণ বেগম বলল-
: আবার কী হইল?
উত্তর দিল বড়জন। সে চেঁচিয়ে বলল-
: আম্মু, শাফিন ডিম রাইখ্যা দিছে!
- কেন, রাইখ্যা দিছে কেন?
সাক্ষীর বদলে এবার আসামি নিজে কাঠগড়ায় দাঁড়াল। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল-
: আম্মু, ডিম কি রসুন দিয়া ভাজছ?
- হ।
: কেন?
শাফিন মেজোজনের নাম। মেজো ছেলের কথা শুনে লবণ বেগম তেরছা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
: যাও। ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিয়া আস।
এর উত্তর একটাই। বাসায় পেঁয়াজ নেই। এজন্য ডিমে রসুন ব্যবহার করা হয়েছে। তারপরও জিজ্ঞেস করলাম-
: আব্বাজান, কী হইছে?
এই জেনারেশনের বাচ্চাকাচ্চারা মনে হয় রিপিটেশন পছন্দ করে না। শাফিন কপাল কুঁচকে বলল-
: কী হইছে- তুমি জান না?
- জানি।
: তাইলে প্রশ্ন করতেছ কী জন্য?
- প্রশ্ন করতেছি, বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝবার জন্য। বল, সমস্যা কী?
: রসুন দিয়া ভাজা ডিম আমি খাই না।
- একদিন খাইলে কোনো অসুবিধা নাই।
: অসুবিধা আছে।
- অসুবিধার কিছু নাই রে বেটা! পেঁয়াজ-রসুন দুইটাই মসলাজাতীয় খাদ্য। আমরা কলের পানি খাই, আবার ডাবের পানিও খাই, তাই না! রসুনে বরং পেঁয়াজের চাইতে বেশি গুণ।
: তোমার লেকচার থামাবা? আমি এই ডিম খাব না, ব্যস।
- ঠিক আছে। এইটা আমার জন্য রাইখ্যা দেও। আমি দোকান থেইক্যা পেঁয়াজ আনতেছি। তোমারে নতুন কইরা ডিম ভাইজ্যা দেওয়া হবে।
ডাইনিং রুম থেকে লবণ বেগমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বললাম-
: শাফিনের সমস্যার সমাধান পাঁচ মিনিটের মধ্যে হইয়া যাবে। পত্রিকা লইয়া কী সমস্যা হইছে- বল।
- একটা নারকেল কুড়াব। কুড়ানির নিচে রাখার জন্য পত্রিকা নিতে আইসা মেজাজ খারাপ।
: কেন?
- আরে! যে পত্রিকাই হাতে লই- খুন-হত্যা, মারামারি-কাটাকাটি ছাড়া আর কোনো সংবাদ নাই। সকালবেলাই এইসব সামনে লইয়া বসতে কার ভালো লাগে!
: ভেতর থেইক্যা একটা পাতা নাও।
- সবখানেই এক অবস্থা।
এ সময় দরজার নিচ দিয়ে হকার পুছ করে পত্রিকা দিয়ে গেল। প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট সুসংবাদ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সফরকারী নিউজিল্যান্ড দলকে হারিয়ে সিরিজ জিতেছে। এটাকে বাংলাওয়াশ নাম দিয়ে পত্রিকায় বিরাট করে খবর ছাপা হয়েছে। লবণ বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম-
: এইটা নাও। এইটার মধ্যে অনেক বড় সুসংবাদ আছে।
- কী সুসংবাদ?
: বাঘা ধোলাইয়ে নিউজিল্যান্ড ছেড়াবেড়া হইয়া গেছে।
লবণ বেগম পত্রিকা হাতে নিল। কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখার পর বলল-
: এক খেলায় বাঘ হইয়া লাভ কী? পরের খেলায়ই দেখা যাবে বিড়ালের মতো মিউ-মিউ করতেছে!
কথাটা খেলা সম্পর্কিত হলেও আমি লবণ বেগমের কথার অন্য একটা অর্থ খুঁজে পেলাম। ১৯৭১ সালে এই জাতি বাঘের মতো গর্জে উঠেছিল। এরপর এতদিন ধরে এই যে এত অনিয়ম-অনাচার চলছে- সেই বাঘের গর্জন আর শোনা যাচ্ছে না। জাতি শুধু বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছে। পেঁয়াজ কেনার জন্য দোকানে যাচ্ছি- রাস্তায় আতর আলীর সঙ্গে দেখা। কুশলাদি বিনিময় শেষে আতর আলী জিজ্ঞেস করল-
: কই রওনা হইলেন?
- দোকানে যামু। আপনে কই যাইতেছেন?
: সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে।
- ওইখানে কেন?
: খবর পাইলাম- ওইখানে নাকি টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি করবে। ৬৫ টাকা কেজি। ভাবলাম-সুযোগটা গ্রহণ করি।
আতর আলীর কথা শুনে বললাম-
: আরে! আমিও তো পেঁয়াজের কেইস লইয়াই দৌড়াইতেছি। চলেন যাই।
আতর আলীর সঙ্গে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গিয়ে দেখলাম অনেক মানুষের ভিড়। শুনলাম- মাথাপিছু দুই কেজি করে পেঁয়াজ দেয়া হবে। ৩০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ ১২০ টাকা হওয়ার পর অগ্রহায়ণ মাসে বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠলে দাম কমবে- এই আশায় আধা কেজি করে পেঁয়াজ কিনে দিন পাড়ি দিচ্ছি। সেই পেঁয়াজ একসঙ্গে দুই কেজি হাতে নিতে পারব ভেবে মনটা খুশিতে নেচে উঠল। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ট্রাকের কোনো নিশানা না দেখে হতাশ হয়ে আতর আলীকে বললাম-
: সঠিক খবর পাইছেন তো!
- খবর সঠিক এই ব্যাপারে আপনে নিশ্চিত থাকেন। খবর সঠিক না হইলে এত লোক এইখানে জড়ো হইত?
সময় যত গড়াচ্ছে, মানুষের লাইন তত লম্বা হচ্ছে। দীর্ঘ লাইনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম-
: এর আগে কলসি হাতে লাইনে দাঁড়াইয়া ওয়াসার পানি সংগ্রহ করছি। এখন পেঁয়াজের জন্য লাইন দিছি। পেঁয়াজও যে লাইনে দাঁড়াইয়া সংগ্রহ করতে হবে- কোনো দিন ভাবি নাই।
আতর আলী আমার কথা শুনে হাসল। বলল-
: লাইনে দাঁড়াইয়া ভোট দিয়া দেশ পরিচালনার জন্য নেতা নির্বাচন করছেন তো! ধইরা নেন- এইটা তার প্রতিদান পাইতেছেন!
ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর ভেতরে অস্বস্তি শুরু হল। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমাকে উশখুশ করতে দেখে আতর আলী বলল-
: ভাই, প্রত্যেক বিষয়ের নেগেটিভ-পজেটিভ দুইটা দিকই আছে। পেঁয়াজের দাম বাইড়া একদিকে লাভ হইছে!
- কী রকম!
: কৃষি মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিছে- সারা বছর চাষ করা যায়, এমন জাতের পেঁয়াজ তারা উদ্ভাবন করবে। বারমাইস্যা জাত উদ্ভাবন হইলে শুধু অগ্রহায়ণ মাস না, সারা বছরই পেঁয়াজের ফুল ফুটবে। তখন পেঁয়াজ আমদানির জন্য ইন্ডিয়ার দরকার লাগব না। আর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গঠন কইরা দামও বাড়াইতে পারবে না।
একে বলে গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। বিষণ্ন কণ্ঠে বললাম-
: ভাই রে! ঘোষণা দিতে তো কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা হইল তার রেজাল্ট লইয়া। এর অগে দোয়েল ল্যাপটপ লইয়া কী ঘোষণা দেওয়া হইছিল, মনে আছে আপনার? বলা হইছিল- ঘরে ঘরে প্রত্যেকের হাতে হাতে দোয়েল নামের ল্যাপটপ শোভা পাবে। সেই দোয়েল বর্তমানে ঠ্যাং-পাখা ভাইঙ্গা চিৎ হইয়া পইড়া রইছে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বিফল মনোরথ হয়ে দোকান থেকে আধা কেজি পেঁয়াজ কিনে বাসায় ঢুকলাম। নাস্তার পাট চুকিয়ে ছেলেরা অনেক আগেই স্কুলে চলে গেছে। লবণ বেগম পেঁয়াজের পোটলার দিকে তাকিয়ে বলল-
: তুমি দোকানে পেঁয়াজ কিনতে গেছিলা, না গরুরহাটে গরু কিনতে গেছিলা?
সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লবণ বেগমকে একটা পয়ার শোনালাম। বললাম-
: আশায় হারাইলাম বাড়ি- বুদ্ধে হারাইলাম দাড়ি।
অবশেষে যেইখানের খাম সেইখানেই গাড়ি॥
বুঝতে না পেরে লবণ বেগম বলল-
: এর মানে কী?
- মানে বোঝাইতে গেলে তো অনেক কথা বলতে হয়। সংক্ষেপে বলতেছি- শোন। এক লোক সুন্দরী এক মহিলার প্রেমে পড়ার পর বিবাহের প্রস্তাব দিলে মহিলা বলল-
: বিবাহ করতে কোনো সমস্যা নাই। তবে আমার কিছু শর্ত আছে।
- কী শর্ত?
: তোমার পুরাতন টিনের বাড়িতে আমি থাকবার পারমু না। আমার জন্য দালান তুলন লাগব। তুমি আজকাই তোমার ভাঙাচোরা বাড়ি আগুন দিয়া জ্বালাইয়া দেও।
আগুন দিয়ে বাড়ি পোড়ানোর পর প্রেমিক পুরুষ সেই মহিলার কাছে যেতেই সে বলল-
: এইবার আরেকটা কাজ করন লাগব।
- কী কাজ?
: তোমার মুখের এই দাড়ি-গোঁফ আমার না-পছন্দ। এইগুলা কামাইয়া পরিষ্কার হইয়া আস।
পয়-পরিষ্কার হওয়ার পর লোকটা মহিলার কাছে গিয়ে বলল-
: তোমার কথামতো কাজ করছি। কবে বিয়া করবা কও?
এ কথা শুনে মহিলা বলল-
: তুমি কি পাগল হইছ- আমি তোমারে বিয়া করমু!
- বিয়ার কথা তো তুমিই বলছিলা!
: বলছিলাম- কিন্তু যে লোক অন্যের কথায় নিজের ঘরে আগুন দেয়, মুখের সুন্দর দাড়ি-গোঁফ চাঁইছ্যা ফেলে- সে যে অন্যের কথায় দুই দিন পরে আমারে খুন করবে না, তার গ্যারান্টি কী?
ব্যর্থ প্রেমিক কী আর করবে! পুড়ে যাওয়া টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর মেরামত করতে গিয়া মনের দুঃখে উপরের ওই কথাগুলি বলতেছিল। আমার ঘটনাও অনেকটা একই রকম। সস্তায় দুই কেজি পেঁয়াজ পাওয়ার আশায় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দঁড়ায়াছিলাম। পেঁয়াজ তো জুটলই না- অফিসেরও দেরি হইয়া গেল। শেষমেশ দোকান থেইক্যা আধা কেজি পেঁয়াজ কিইন্যা বাসায় আসতে হইল।
আমার দুরবস্থার কথা শুনে লবণ বেগম বলল-
: বাস্তবিকপক্ষেই তুমি যে একটা বোকা লোক- এইটা উপলব্ধি করতে পারছ শুইন্যা খুশি হইলাম।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.